বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা বাদ: প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ অ্যাক্টিভিস্টদের

মুজিববর্ষের বিশেষ অধিবেশনে সংসদে শোনানো জাতির পিতার ভাষণ থেকে কিছু অংশ বাদ দেওয়ার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন দুইজন অ্যাক্টিভিস্ট। 

সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2020, 01:36 PM
Updated : 19 Nov 2020, 01:51 PM

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ প্রসঙ্গে কিছু অংশ বাদ দিয়ে সংসদে শোনানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।

সংসদে প্রচার করা ভাষণে বঙ্গবন্ধুর মূল বক্তৃতার কিছু অংশ যে বাদ পড়েছে, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও তা স্বীকার করেছেন। তবে তার ভাষ্য, সংসদ ওই ভাষণ সম্পাদনা করেনি, বেতার থেকে পাওয়া ভাষণটি হুবহু প্রচার করা হয়েছে।

অন্যদিকে বেতার বলছে, আর্কাইভে যেভাবে আছে, সেই ভাষণটিই সংসদকে দেওয়া হয়েছে, সেখানে নতুন করে কিছু করা হয়নি।

তাহলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের অডিও রেকর্ড থেকে কবে কখন কীভাবে ওই অংশটি বাদ দেওয়া হল, সে উত্তর মেলেনি।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদে ওই ভাষণটি দিয়েছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সংসদে আনা সাধারণ প্রস্তাব গ্রহণের আগে গত ১৫ নভেম্বর সেই ভাষণটিই অধিবেশনে শোনানো হয়।

কিন্তু সেখানে কিছু অংশ বাদ পড়ায় ১৬ নভেম্বর ফেইসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মাহবুবুর রহমান জালাল।

তিনি লেখেন- “সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ (১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য) এ এডিট !!!”

সেই ফেইসবুক পোস্টে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সেন্টার ফর বাংলাদেশ জেনোসাইড রিসার্চের প্রেসিডেন্ট জালাল।

“বঙ্গবন্ধুর ভাষণ (১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য) টির একটি বিশেষ বিষয়ে আলোচনার সময় এডিট করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি একটু দেখবেন।”

 

সুইজারল্যান্ড প্রবাসী ব্লগার অমি রহমান পিয়ালও বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকটি ফেইসবুক পোস্টে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

এর একটিতে তিনি লিখেছেন, “মানবিক ভুল বইলা একটা জিনিস আছে। বঙ্গবন্ধুর উপর বিশেষ অধিবেশনে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির উপর তার বক্তৃতা এডিট করা হইছে। ধর্ম নিরপেক্ষতার উপর তার ব্যাখ্যা বাদ দেয়া হইছে। মনে একটু দ্বিধা ছিলো এটা হয়তো ভুলে হইছে, ভুলে বাদ দিছে। কিন্তু যখন সংসদের অনুষ্ঠানের ভিডিও দেখলাম, মাথা নষ্ট অবস্থা!”

পিয়াল বলছেন, অডিওর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যেসব ছবি ব্যবহার করে ওই ভিডিও তৈরি করা হয়েছে, তাতে তার মনে হয়েছে, ভাষণ থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গ ভুলক্রমে বাদ পড়েনি, সেটা ‘ইচ্ছাকৃত’।

জাতির পিতার মূল ভাষণের কোন কোন অংশ ওই অডিও থেকে বাদ পড়েছে, তার বিস্তারিত আরেকটি ফেইসবুক পোস্টে তুলে ধরেছেন পিয়াল।

ভাষণ থেকে কী বাদ পড়েছে?

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর তখনকার গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গ্রহণ করা হয়। সেই সংবিধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাষণে ব্যাখ্যা দেন জাতির পিতা। সেখানে তিনি রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

গত ১৫ নভেম্বর সংসদে প্রচারিত অডিওতে মূলনীতির প্রথম তিনটি বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য তুলে ধরা হলেও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে তার কথার একটি অংশ ছিল না। এছাড়া সমাজতন্ত্র নিয়ে তার বক্তব্যের একটি অংশও বাদ পড়েছে।

সংসদে যে ভাষণ শোনানো হয়েছে, তা ৪৫ মিনেটের। তবে সংসদের রেকর্ডে যে লিখিত ভাষণ আছে, তা ‘এক ঘণ্টার মত’।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রয়াত সংসদ সদস্য ও সাংবাদিক বেবী মওদুদের সম্পাদনায় আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৭২-৭৫)’ বইতে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের একটি অনুলিপি রয়েছে।

সেই অনুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে, সংসদে বাজানো ভাষণে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বক্তব্যের বেশ খানিকটা নেই।  

ধর্মরিনেপক্ষতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের অনুলিপিতে আছে-

“তার পরে আসছে ধর্মনিরপেক্ষতা। জনাব স্পিকার সাহেব, ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না।

“ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়া ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না।

“আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, পবিত্র ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি- ধর্মের নামে কি জুয়োচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আবি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।”

সংসদে প্রচারিত ভাষণে যে অংশটি বাদ পড়েছে-

“ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না।

“ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়া ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না।

ওই ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে ব্যাখ্যা করার আগে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের আরেক মূলনীতি ‘সমাজতন্ত্র’ নিয়ে কথা বলেন।

ভাষণের অনুলিপিতে সেই অংশটি এরকম-

“তৃতীয়ত সোশ্যালিজম বা সমাজতন্ত্র। আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। এবং বিশ্বাস করি বলেই আমরা এগুলি জাতীয়করণ করেছি। যারা বলে থাকেন সমাজতন্ত্র হল না, সমাজতন্ত্র হল না, তাদের আগে বোঝা উচিত, সমাজতন্ত্র কী। সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েত রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল, অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্র বুঝতে পারে নাই। সমাজতন্ত্র গাছের ফল না- অমনি চেখে খাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুরও হয়। সেই পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো যায়।

“সেজন্য পহেলা স্টেপ, যাকে প্রথম স্টেপ বলা হয়, সেটা আমরা গ্রহণ করেছি- শোষণহীন সমাজ। আমাদের সমাজতন্ত্র মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কী ক্লাইমেট, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সব কিছু বিবেচনা করে স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে।...

“কিন্তু আমরা নয় মাসে যে পদক্ষেপগুলি নিয়েছি, তা আমার মনে হয়, দুনিয়ার কোনো দেশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে সোশালিজম করেছে, তারাও আজ পর্যন্ত তা করতে পারে নাই। আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কোনো কিছু করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা প্রসেসের মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।”

এর মধ্যে শেষের প্যারাটি সংসদে প্রচারিত ভাষণ থেকে বাদ পড়েছে।  

বাদ পড়ল কীভাবে?

স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বলেছেন, ভাষণ থেকে কিছু অংশ বাদ পড়ার বিষয়টি তারও নজরে এসেছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই ভাষণটি বাংলাদেশ বেতার থেকে সংগ্রহ করে হুবহু সম্প্রচার করা হয়েছে। আর কেবল ধর্ম নিরপেক্ষতার অংশ নয়। সংসদের প্রসিডিংসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে, আরো ছোট ছোট কিছু বিষয় ভাষণের অডিওতে নেই।”

তিনি বলেন, সংসদের যে লিখিত প্রসিডিংস, সেখানে জাতির পিতার ভাষণ এক ঘণ্টার মত। কিন্তু বেতার থেকে যে অডিও সংসদ পেয়েছে, সেটা ৪৫ মিনিটের একটু বেশি।

“সংসদের ছাপানো প্রসিডিংসে যেটা আছে হার্ড কপি, সেটার মধ্যে যে কথাগুলো আছে, তার বেশ কিছু অডিও ভার্সনে নেই, এটা ঠিক।”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক হোসনে আরা তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি খোঁজ নিয়েছি। আর্কাইভে থাকা জাতির পিতার ওই ভাষণ যেভাবে আছে সেভাবেই সংসদে পাঠানো হয়েছে। আর্কাইভে থাকা ওই রেকর্ডেই কিছু অংশ নেই।”

তিনি বলেন, “সংসদে যেটা পাঠানো হয়েছে এবং আমাদের আর্কাইভে যেটা রয়েছে, দুটো একই। যা আমাদের কাছে আছে সেটাই সংসদে দেওয়া হয়েছে।”

সংসদ সচিবালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সফট কপি চেয়ে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালককে চিঠি দেয় সংসদ সচিবালয়। পরে বেতার থেকে অডিও সরবরাহ করা হয়।

বেতার থেকে কেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নেওয়া হল জানতে চাইলে সংসদ সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বর্তমান সংসদ ভবনে সংসদের কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগের অনেক কিছুই সংরিক্ষত নেই। পুরনো অনেক নথি সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে।

“সেটা যে এখন হয়েছে তা নয়। পুরনো পার্লামেন্ট ভবন থেকে এখানে (১৯৮২ সালে) স্থানান্তরিত হওয়ার সময় হয়ত হয়েছে। কিংবা তারও আগে। তাছাড়া এক সময় সংসদে দেওয়া বক্তব্য রেকর্ড করে রাখা হলেও সেগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। প্রসিডিংসে লেখার পর হয়তো আর সংরক্ষণ করা হয়নি। যেটা এখন ডিজিটালি করা হয়। লিখিত প্রসিডিংসগুলো আমাদের কাছে আছে। সেটা সঙ্কলনও করা হয়েছে।”

ওই কর্মকর্তা জানান, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের জন্য সম্ভাব্য আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এই ভাষণটি বেতার থেকেই পাওয়া গেছে।