ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোসাম্মৎ কামরুন্নাহার বৃহস্পতিবার এই রায় দেবেন।
আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছেন দাবি করে রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছে, রায়ে মজনুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডই হবে।
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ার আগে এই মামলার বিচার সম্পন্ন হওয়ায় রায় পূর্ববর্তী আইনেই হবে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
অন্যদিকে মজনুর বিরুদ্ধে চাক্ষুস কোনো সাক্ষী ছিল না বলে রায়ে তার অব্যাহতি আশা করছেন আসামি পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী রবিউল ইসলাম রবি।
গ্রেপ্তারের পর রিমান্ড শেষে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন মজনু।
তিনি বলেছিলেন, “আমার মা ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই। আমাকে মায়ের কাছে যাইতে দেন। আমি এই কাম করি নাই। আমারে ছাইড়া দ্যান।”
তবে ধর্ষণের শিকার ওই তরুণী রুদ্ধদ্বার আদালত কক্ষে দাঁড়িয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মজনুকে ধর্ষণকারী হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন। তিনি র্যাবকেও বলেছিলেন, তার উপর নিপীড়নকারীর চেহারা জীবনেও ভুলতে পারবেন না তিনি।
মজনু বলেন, “সে (ভিকটিম) বলছে যে আমার দুই দাঁত ভাঙা, আসলে আমার ৭/৮টা দাঁত ভাঙা।”
এই বছরের ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর ঢাকার কুর্মিটোলায় নির্জন সড়কের পাশে ধর্ষণের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী। পরদিন তার বাবা ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন।
তিন দিন বাদে মজনুকে গ্রেপ্তার করে র্যাব জানায়, নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে ১০ বছর আগে ঢাকায় আসা এই ব্যক্তিই ধর্ষণকারী।
তদন্ত শেষে দুই মাস পর গত ১৬ মার্চ ডিবির পরিদর্শক আবু বকর সিদ্দিক আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তাতে শুধু মজনুকেই আসামি করা হয়। ভুক্তভোগীর পোশাক ও মোবাইল ফোনসহ ২০টি আলামত তিনি জমা দেন আদালতে।
গত ২৬ আগস্ট ভার্চুয়ালি শুনানিতে মজনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২৪ সাক্ষীর মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্য নিয়ে রায় দিতে যাচ্ছেন বিচারক।
মামলা থেকে বিচার
৫ জানুয়ারি | ধর্ষণের শিকার হন ওই তরুণী |
৬ জানুয়ারি | ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা |
৮ জানুয়ারি | মজনুকে গ্রেপ্তার |
১৬ জানুয়ারি | মজনুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি |
১৬ মার্চ | মজনুর বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগপত্র |
১৬ অগাস্ট | আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণ |
২৬ অগাস্ট | মজনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন |
৯ সেপ্টেম্বর | সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু |
৫ নভেম্বর | সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ |
১২ নভেম্বর | যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের দিন নির্ধারণ |
আসামি মজনুর পক্ষে কেউ সাফাই সাক্ষ্য দেয়নি। তার পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় ঢাকা জেলা লিগ্যাল এইডের পক্ষে রবিউল ইসলাম রবিকে আসামি পক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
রায়ের আগে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলাটিতে মজনু আসল আসামি নন। ঘটনাটির কোনো চাক্ষুস সাক্ষী নেই। রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।”
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আফরোজা ফারহানা আহম্মেদ অরেঞ্জ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৩ কার্যদিবসে আমরা মামলার কার্যক্রম শেষ করেছি।
“মামলার একমাত্র আসামি মজনুর বিরুদ্ধে আমরা ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। এছাড়া তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন।”
এক প্রশ্নের উত্তরে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বলেন, “যেহেতু মামলাটিতে খুব ঘন ঘন তারিখ পড়েছে, সে কারণে সকল সাক্ষীর বক্তব্য বিচারকের মনে ছিল। যে কারণে আমাকে যুক্তিতর্ক শুনানিতে তেমন কিছু বলতে হয়নি।”
আসামি মজনু বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন। তার উপস্থিতিতেই আদালতের রায় হবে।
‘সব ক্ষেত্রেই যেন এমন হয়’
ধর্ষণের শিকার তরুণী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় সরকারের বাড়তি তৎপরতায় বিচার দ্রুত হয়েছে মন্তব্য করে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আফরোজা ফারহানা আহম্মেদ অরেঞ্জ বলেছেন, সব ক্ষেত্রেই এমন হওয়া উচিৎ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ঘটনার মামলায় রাষ্ট্রের অনেক খরচ হয়েছে। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পুলিশ, বেশি সতর্কতা গ্রহণ, খুব দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি।
“যদি ভিকটিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হয়ে অন্য কোনো প্রান্তিক শ্রেণির কেউ হত, তবে এত আয়োজন করা হত না।”
সহপাঠী ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর প্রকাশের পর ধর্ষণকারীকে গ্রেপ্তার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা, যাতে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও নানা সংগঠনও নেমেছিল বিক্ষোভে।
সম্প্রতি আরও কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের সঞ্চার করে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে আইন সংশোধন করা হয়েছে।
আইনজীবী ফারহানা বলেন, “শুধু ঢাকা কিংবা অপর কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই নয়, সকল পেশা বা বা সমাজের সকল স্তরের নারী যেন নিরাপদে রাস্তায় হাঁটতে পারে।
“আর মজনুর মতো সামাজিক মর্যাদার মানুষের জন্য এ রকম বিচারের আয়োজন না করে বরং যে সব মামলায় সমাজের রাঘব-বোয়াল ধনী তথাকথিত অভিজাত শ্রেণির আসামি রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বিচারের এ রকম আয়োজন থাকলে আমাদের ভালো লাগত।”
কে এই মজনু?
মজনুকে গ্রেপ্তারের পর র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মজনুর বয়স আনুমানিক ৩০ বছর, বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়। জীবিকার তাগিদে বছর দশেক আগে তিনি ঢাকা আসেন।
মজনুর বাবা মাহফুজুর রহমান মারা গেছেন আগেই। মা জীবিত থাকলেও বাড়ির সঙ্গে মজনুর কোনো যোগাযাগ নেই বলেও র্যাব জানায়।
নিরক্ষর মজনু ১২ বছর আগে ট্রেনে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলেন। এই ভাঙা দাঁতের বিষয়টি তদন্তের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বলে জানান র্যাবের কর্মকর্তা সারোয়ার বিন কাশেম।
তিনি বলেন, “সে (মজনু) একসময় বিবাহিত ছিল। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে।”
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মজনু বলেছেন, তিনি পেশায় দিনমজুর, হকার। পাশাপাশি তিনি ‘ছিনতাই, রাহাজানি, চুরির মত কাজেও’ জড়িত ছিলেন বলে র্যাবের ভাষ্য।
“সে আমাদের কাছে প্রাথমিক স্বীকারোক্তি দিয়েছে, সে সিরিয়াল রেপিস্ট। সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক মহিলাকেও নানাভাবে ধর্ষণ করেছে। সে মাদকাসক্ত।”
মজনুকে ‘সিরিয়াল রেপিস্ট’ আখ্যায়িত করে র্যাব কর্মকর্তা কাশেম বলেন, “তার স্ত্রী যখন মারা যায়, তারপর আসলে তার যা অবস্থা, সে আর কাউকে বিয়ে করতে পারেনি। তখন যেটা সে করত, বিভিন্ন ভিক্ষুক, তাদের সে ধর্ষণ করত। এবং প্রতিবন্ধী নারী, তাদের সে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে এনে রাখত এবং এই কাজগুলো করত।”
যেভাবে গ্রেপ্তার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীর কাছ থেকে অপরাধীর দেহের বর্ণনা শুনে মজনুকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে।
ওই তরুণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থেকে কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে নেমে বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছিলেন। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় ধর্ষণকারী তাকে জাপটে ধরে একটি ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে ধর্ষণ করে।
র্যাব কর্মকর্তা সারোয়ার বিন কাশেম বলেছিলেন, সেই রাতে মেয়েটির ফেলে যাওয়া মোবাইল ফোন, ব্যাগ এবং পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন মজনু। কুর্মিটোলায় এক নারীর কাছে ফোনটি বিক্রি করে দেন ৫০০ টাকায়। সেখান থেকে মজনু চলে যান নরসিংদীতে। পরদিন ফিরে আসেন ঢাকায়।
র্যাব কর্মকর্তা কাশেম বলেন, ভিকটিমের মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে তারা খায়রুল নামে এক রিকশাচালককে আটক করেন। খায়রুল ওই মোবাইল কিনেছিলেন সেই নারীর কাছে।
“তার দেওয়া তথ্যের সঙ্গে ভিকটিমের তথ্য মিলিয়ে আমরা সিদ্ধান্তে আসি যে তারা (মোবাইল বিক্রেতা ও ধর্ষক) একই ব্যক্তি। কারণ তার বাড়ি নোয়াখালী, স্থানীয় ভাষায় সে কথা বলে, তার সামনে দাঁত নেই। চুল কোঁকড়া এবং সে খর্বকায়। এই তথ্যগুলো মিলিয়ে আমরা তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই।”
পরে ওই তরুণীকে মজনুর ছবি দেখিয়ে নিশ্চিত হন বলে জানান র্যাব কর্মকর্তা সারোয়ার।