এসি বিস্ফোরণ কেন, কার দায় কতটুকু?

গত বছর রাজধানীর উত্তরায় বাসায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র (এসি) বিস্ফোরণে মারা যান আলমগীর-বিলকিস দম্পতি।

নিজস্ব প্রতিবেদকমেহেরুন নাহার মেঘলাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Nov 2020, 07:06 PM
Updated : 9 Nov 2020, 02:39 AM

এবছর আফতাবনগরের বাসায় এসি বিস্ফোরণে একমাত্র সন্তান স্বপ্নিল আহমেদ পিয়াসকে হারান সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু।

সদ্য স্নাতক পিয়াসের শরীরের সঙ্গে পুড়ে যায় জীবনের সকল স্বপ্ন।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা সামন্ত লাল সেন জানান, তিন-চার বছর যাবত তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা দগ্ধ রোগীদের মধ্যে অনেকেই এসি বিস্ফোরণের শিকার। এই সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে।

এসি বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে প্রধানত দুই ধরনের বিষয়কে দায়ী করে থাকেন সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা- এসির মান নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি ও সময়মতো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়া।

এর মধ্যে ব্যবহারকারীদের অসচেতনতাই বিস্ফোরণের প্রধান কারণ। তবে বিস্ফোরক দ্রব্য হিসেবে বাজারে মানসম্পন্ন এসি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে পর্যাপ্ত ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে বলেও তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সার্ভিসের অপারেশন ও মেইন্টেন্যান্স বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমানের মতে, ত্রুটিপূর্ণ তারের ব্যবহার, কমদামী ননব্র্যান্ডের এসি কেনার প্রবণতা ও একটানা বহুক্ষণ এসি চালানোসহ অসচেতনতার কারণে বিস্ফোরণ ঘটে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, দেশে বেশিরভাগ বাসাবাড়ি আশির দশকে তৈরি, ওয়্যারিং সিস্টেম এসি ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত না। সেজন্য তারে ত্রুটি থাকলে শর্ট সার্কিট থেকে বিস্ফোরণ হয়।

অনেকে খরচ কমাতে নন-ব্র্যান্ডের এসি কেনেন, যেগুলোতে নকল ও ত্রুটিপূর্ণ কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়। তাই সেখানে বিস্ফোরণের ঝুকি থাকে। অবিরাম এসি চলতে থাকলেও বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

শীতকালসহ বছরের কয়েকমাস এসি বন্ধ থাকলে চালু করার আগে সার্ভিসিংয়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেটা অনেকেরই খেয়াল থাকে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক অলোক কুমার মজুমদার বলেন, এসির কম্প্রেসরের ভেতরে ছোট্ট পাইপ আছে, যাতে গ্যাস থাকে। এসি দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকায় সেখানে গ্যাসের বুদ্বুদ সৃষ্টি পারে বা লুব্রিকেটিং অয়েল জমেও পাইপটি জ্যাম হতে পারে।

“হঠাৎ করে এসি চালু করলে ছোট পাইপে প্রবল চাপ তৈরি হবে, তখন বিস্ফোরণ ঘটবে। রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস দাহ্য হওয়ায় বিস্ফোরণের সময় ধাতব বস্তুর ঘর্ষণে প্রচণ্ড তাপ সৃষ্টি করবে এবং এর ফলে আগুন ধরে যাবে।”

নিয়মিত এসি রক্ষণাবেক্ষণের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ঘরের বাইরে এসির আউটডোর ইউনিটে ফিল্টার ও ফ্যান থাকে। ফ্যান ধূলোবালিতে জ্যাম হয়ে গেলে এসি ঠিকমত ঠাণ্ডা হবে না। ফলে ফ্যান গরম হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

অলোক বলেন, “যে কোনো ক্যাবল বেশি সময় চললে গরম হয়। আর এসির ক্যাবল নরমাল টিভি বা অন্য যন্ত্রের মতো না। এগুলো উচ্চ বৈদ্যুতিক শক্তিসম্পন্ন হওয়া জরুরি। দেড় দুই টনের এসি ১০-১২ এম্পিয়ার বিদ্যুৎ টানে। নিম্ন মানের কেবল হলে আগুন ধরে যেতে পারে। তাই সার্কিট ব্রেকার, সুইচ এগুলো ভালো মানের হতে হবে।”

শুধু ব্যবহারকারী নয়, এসি বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে বিক্রেতা ও নীতিনির্ধারক- সবারই দায় আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।

তিনি বলেন, কারো বাসায় লাগবে দুই টনের এসি, কিন্তু তিনি যদি এক টনের এসি কেনেন, তাহলে ঘর শীতল করার জন্য সেই এসি লম্বা সময় ধরে চালাতে হবে। ফলে এসির আয়ু কমে যাবে, সঙ্গে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে।

এসি বসানোর ক্ষেত্রে দক্ষ টেকনিশিয়ানের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “এসি বসাতে হবে সার্টিফাইড টেকনিশিয়ানদের সাহায্যে। এসি বসানোর সময় আউটডোর ইউনিটটা কোথায় বসাতে হবে তা ঠিক করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। খোলা বাতাসে না রাখলে সেটি গরম হয়ে যাবে। একে বাইরে তাপ ছাড়ার সুযোগ দিতে হবে।”

বাংলাদেশে ৫০ হাজারের মত টেকনিশিয়ান আছে এই পেশায়, তার মধ্যে ১০ হাজারেরও প্রশিক্ষণ নেই বলে আক্ষেপ করেন অলোক কুমার মজুমদার।

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

বাজারে মানসম্পন্ন এসির সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলকেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন যন্ত্রকৌশলের এই অধ্যাপক।

তিনি বলেন, সরকারি কিংবা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দায়িত্ব এসির গুণগত মান যাচাই করে আমদানি বা বাজারজাতকরণের অনুমোদন দেওয়া। পাশাপাশি মানুষ সস্তা ও নিম্ন মানের এসি কেনা বন্ধ না করলেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকবে।

যে কোনো পণ্যের গুণগত মান যাচাই ও পরীক্ষা করে সেটি বাজারে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য অনুমোদন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই)।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রের মান নির্ধারণ ২০১৮ সাল থেকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বলে জানান বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেশন মার্কস উইংয়ের পরিচালক সাজ্জাদুল বারী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এসি পরীক্ষা করে মানসম্পন্ন এবং ত্রুটিমুক্ত নিশ্চিত করে বাজারজাত করার অনুমোদন দেওয়া হয়।”

২০০৪ সালের বিস্ফোরক বিধিমালা অনুযায়ী, বিস্ফোরণের ঝুঁকিপূর্ণ, বিস্ফোরক দ্রব্য এবং উপাদানের নিয়মিত তালিকা প্রকাশের দায়িত্ব বিস্ফোরক পরিদপ্তরের। বিস্ফোরক আমদানি ও পরিবহন ও বিক্রির ক্ষেত্রে পরীক্ষা করে এই দপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়।

এসি বিস্ফোরণ ঠেকাতে পর্যাপ্ত নেওয়া হয় কি না জানতে চাইলে প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, “সব ধরণের বিস্ফোরণের ঘটনাই বিস্ফোরক পরিদপ্তরের আওতাধীন নয়। এটি শুধু একটি পরিদপ্তর মাত্র। এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপর বর্তায়।”

আরও খবর