ড্যাপ পরিকল্পনায় নানা ‘অসঙ্গতি’ দেখছেন নগরবিদরা

রাজধানী ঢাকাকে আধুনিক ও বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে রাজউক যে ২০ বছর মেয়াদি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রণয়ন করছে, তাতে নানা অসঙ্গতি দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2020, 06:18 PM
Updated : 2 Nov 2020, 06:18 PM

সোমবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স-বিআইপির উদ্যোগে ‘ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা নিয়ে বিষয়ভিত্তিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় তারা নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।

বিআইপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আকতার মাহমুদের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খানের সঞ্চালনায় এই ভার্চুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।

এছাড়াও সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি এবং প্রখ্যাত নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, পরিবহণ বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সংস্থা-বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক শাকিল আকতার, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম,রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান ঢাকা ওয়াসার ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ওয়াটার মাস্টার প্ল্যান সভায় তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ঢাকা ওয়াসার ওয়াটার মাস্টার প্ল্যান বিবেচনা করা না হলে ওয়াসার পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে। ঢাকাকে বালতি বানানো যাবে না, সেজন্য আমাদের ১২ শতাংশ জলাধার নিশ্চিত করতে হবে এবং উন্মুক্ত স্থানের সংখ্যা বাড়াতে হবে।”

এছাড়াও কোনো শ্রেণিবিভাগ ছাড়াই বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলো বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় নির্দিষ্ট করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।

বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “১৯৫৩ সালের আইন দিয়ে ঢাকার উন্নয়ন সম্ভব না। রাজউককে ঢেলে সাজাতে হবে, সেখানে উন্নয়ন কার্যক্রম এবং পরিচালনা কার্যক্রম আলাদাভাবে চালাতে হবে।

“এছাড়াও জলাশয় ফিরিয়ে আনার জন্য কী প্রস্তাব রাখা হয়েছে তা জানাতে হবে এবং জলাশয় আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে।”

ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় অনেক পরিবর্তনের কথা বলা হলেও তার পর্যালোচনা সঠিকভাবে উল্লেখ করা হয়নি বলে মন্তব্য করেন বুয়েটের অধ্যাপক শাকিল আকতার।

তিনি বলেন, “মিশ্র ব্যবহার শর্তসাপেক্ষে প্রয়োগ করা যাবে বলা হলেও শর্তগুলো কোথাও উল্লেখ নেই। ঢাকা ওয়াসার ওয়াটার মাস্টার প্ল্যানের বাস্তব প্রতিফলন ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ফুটে উঠেনি।

“রাস্তায় কী পরিমাণ ট্রাফিক ভলিউম, সেই ভলিউমের ভিত্তিতে কোথায় স্টপেজ হবে, রাস্তার চওড়া কেমন হবে সেটাও পরিকল্পনায় বলা হয়নি। ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্টের জন্য যেসব জোনের কথা বলা হয়েছে, সেখানে কীভাবে আইন প্রয়োগ করা হবে তারও কোনো উল্লেখ নেই এ পরিকল্পনায়। নতুন স্টেশনগুলো তৈরি হলে সেটার জন্য যে পরিমাণ যানবাহনের চাহিদা তৈরি হবে, তা পূরণ করার জন্য করণীয় কী সে সম্পর্কিত কোনো দিকনির্দেশনা এ পরিকল্পনায় প্রদান করা হয়নি।”

বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উন্নয়ন) ও পরিকল্পনাবিদ চৌধুরী মো. জাবের সাদেক বলেন, “ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় আবাসিক এলাকাগুলো উল্লেখ করা হলেও সেখানে কাদের বাসস্থান বরাদ্দ দেওয়া হবে এবং কারা বাসস্থান প্রদান করবে, তা স্পষ্ট করা হয়নি।

“ঢাকা শহরে বাসস্থানের চাহিদার পরিমাণ কত তারও কোনো উল্লেখ ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় নেই। নিম্ন আয়ের মানুষের বাসস্থানের চাহিদা পূরণ করতে কতগুলো আবাসন তৈরি করতে হবে এবং কোন এলাকায় তারা বসবাস করবে তা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় উল্লেখ করতে হবে।”

ঢাকাকে বসবাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদে ভূমি ব্যবহার, পরিবহণ ও নাগরিক সুযোগ সুবিধা পরিকল্পনার মধ্যে এনে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বলে মত দেন অধ্যাপক শামসুল হক।

তিনি বলেন, “ভূমি ব্যবহার, পরিবহন ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধাদির সাথে সাথে রাস্তারও সুবিন্যাস থাকা উচিৎ। কিন্তু ঢাকার সড়কের কোনো বিন্যাস নেই। এছাড়া যানজট কমানোর দোহায় দিয়ে নতুন নতুন পরিবহণ স্টেশনগুলোর যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেখানে যাত্রী কোথায় দাঁড়াবে বা ফুয়েল স্টেশন কোথায় হবে সেগুলোর সুনির্দিষ্ট কোনো উল্লেখ এ পরিকল্পনায় নেই।

“সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে অপরিকল্পিত উন্নয়নের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবকাঠামোর উপর ভিত্তি করে একটা শহরের বাসযোগ্যতা হবে না, বাসযোগ্য শহর গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক সংশোধন করতে হবে এবং অতীতে পরিকল্পনাগুলো কেন বাস্তবায়ন করা হয়নি সে দিকেও নজর দিতে হবে।”

১০ লাখ বাসিন্দার জন্য পূর্বাচলে যে পরিকল্পিত শহরের পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেখানে কর্মসংস্থানের কতটা সুযোগ রয়েছে এবং নাগরিক সুবিধাগুলো কীভাবে নিশ্চিৎ করা হবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “নতুন শহর গড়ে তুললে সেটাকে স্বতন্ত্র শহর হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা থাকতে হবে। অন্যথায় নতুন নতুন শহর গড়ে উঠলেও কেন্দ্রীয় শহরের উপর চাপ কমবে না বরং আরও বৃদ্ধি পাবে।

“সবার জন্য আবাসন চাইলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ কতটুকু জমি পাবে এবং কোথায় পাবে সেটাও উল্লেখ করতে হবে। এছাড়া কত জনসংখ্যার জন্য কতটুকু খোলা জায়গা, খেলার মাঠ বরাদ্দ রয়েছে সেটার বাস্তবায়ন করতে হবে।”

ড্যাপ পরিকল্পনায় রাজউকের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কী থাকবে, তারও একটা সুনির্দিষ্ট কাঠামো থাকা উচিৎ বলে মনে করেন অধ্যাপক নজরুল।

ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ঢাকাকে অবৈধ দখল ও দুর্নীতির হাত থেকে পুনরুদ্ধারের জনসম্পৃক্ত পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানান বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল।

বিআইপি সভাপতি আকতার মাহমুদ বলেন, “জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য এলাকভিত্তিক ভবনের উচ্চতা নির্ধারণের সাথে সাথে ডুয়েলিং ইউনিট (আবাসন সংখ্যা) বিবেচনা করা যায় কি না সে বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।

“মিশ্র ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মিশ্র ভূমি ব্যবহারে কী ধরনের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে এটা বিবেচনায় রাখতে হবে। অন্যথায় ঢাকা শহর অবাসযোগ্য হবে।”

রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম রাজধানীর স্কুলভিত্তিক উন্নয়ন, খাল সংরক্ষণ, আবাসন খাতের নানা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।

তিনি জানান, ড্যাপ নিয়ে রাজউক এখন গণশুনানি করছে। গণশুনানি থেকে আসা আবেদন ও মতামত সংগ্রহ করে ড্যাপের সারাংশ তৈরি করা হবে।

মেয়র আতিকুল ইসলাম নগরের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন,

“উত্তরা পরিকল্পিত এলাকায় পরিকল্পনা মাফিক কোনো কাঁচাবাজার নেই। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভাবে লেক ভিউতে গড়ে উঠছে উচ্চতর ভবন, খেলার মাঠ বা খোলা জায়গাও চলে যাচ্ছে দখলে।”

এছাড়া বাস বা ট্রাক টার্মিনালের অনুপস্থিতি, পুলিশের জব্দ করা পরিবহনগুলোর জন্য কোনো ডাম্পিং স্টেশন নাই।

মেয়র বলেন, “ভূমির বিন্যাস নিশ্চিত করার মাধ্যমে টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং প্রাকৃতিক জলাশয়, খাল, পুকুর সংরক্ষণ করতে হবে।

নতুন ১৮ টি ওয়ার্ডের অ্যাকশন প্ল্যান করা হয়েছে এবং এই প্ল্যান বিবেচনায় রেখেই নতুন ওয়ার্ডের উন্নয়ন করা হবে। ওয়ার্ড কমপ্লেক্স তৈরির মাধ্যমে নাগরিক সুবিধা প্রদান করা হবে।”

ঢাকা শহরকে বাঁচাতে ঢাকার জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব কমানোর জন্য অন্য শহরকে বিবেচনায় রেখে জাতীয় পরিকল্পনা করার কথা বলেন তিনি।