বহু শিশুর কাঁধে মহামারীর ‘ভার’

কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের এই দেশে বিনামূল্যে পাঠ্যবই, উপবৃত্তিসহ সরকারের নানা উদ্যোগে গত কয়েক দশকে শিশুদের স্কুলমুখী হওয়ায় সাফল্য এলেও করোনাভাইরাস মহামারীর অভিঘাতে সেই অর্জন এখন হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Oct 2020, 05:23 PM
Updated : 30 Oct 2020, 06:05 PM

বাবা-মায়ের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে এরইমধ্যে ঢাকাসহ অন্যান্য শহর ছেড়েছে বহু শিশু, অর্থনৈতিক দুর্দশার শিকার হয়ে কাউকে কাউকে বই-খাতা ছেড়ে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে, কেউ কেউ যাচ্ছে কল-কারখানায়, কেউ গাড়ির হেলপারি করছে। এছাড়া দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধের কারণেও লেখাপড়া ছেড়ে ঘোরাঘুরি-খেলাধুলা ও আড্ডায় মেতেছে অনেক শিশু-কিশোর।

এই পরিস্থিতিতে মহামারী শেষে স্কুল খুললে বাংলাদেশে কত সংখ্যক শিশু লেখাপড়ার বাইরে চলে যাবে, সেই পরিসংখ্যান এখনও আসেনি। তবে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলছেন, ৪০ শতাংশ শিশু ঝরে পড়বে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।     

মহামারীর ধাক্কায় যেসব শিক্ষার্থীর আর শ্রেণিকক্ষে ফেরা হবে না, তাদের একজন শিল্পী আক্তার; পরিবারের আর্থিক টানাপড়েনের কারণে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়েছে ১২ বছরের এই কিশোরী।

নরসিংদীর বেলাব উপজেলার লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এই শিক্ষার্থীর বাবা করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতেই ঢাকার একটি ব্যাগ তৈরির কারখানা থেকে চাকরি হারান।

কিছু দিনের মধ্যেই পাঁচ সদস্যের এই পরিবারে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয় তাতে হোঁচট খায় বড় মেয়েকে লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন।

শিল্পীর মা হাজেরা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরারও ইচ্ছা আছিল মাইয়ারে ডাক্তার-উকিল বানানোর। কিন্তু কী করুম, আমরা গরিব মানুষ। মেয়ের বাপের চাকরি যাওয়ার পর কোনো দিশা না দেইখ্যা তারে বিয়া দিয়া দিছি।”

লকডাউনের শুরুতে শিল্পীর পরিবারের মতোই সংকটে পড়ে ঢাকার মিরপুরের একটি বস্তির বাসিন্দা ইমনের পরিবার।

মা গৃহকর্মীর কাজ ও বাবা দোকানের কাজ হারানোর পর মিরপুরের ‘নন-লোকাল ফ্রি স্কুলের’ এই শিক্ষার্থী সংসারের ভার সামলাতে অ্যামব্রয়ডারি কারখানায় কাজ নেয়।

১৪ বছরের ইমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “বাড়িতে এখন আর টাকা কামানোর কেউ নাই। সেই কারণেই আমি চাকরিতে ঢুকছি। টানা ১২ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়, পড়মু কেমনে?”

ঢাকার পাশের জেলা গাজীপুরের সুরভি আক্তারের বাবা রিকশা চালান, মা কৃষি শ্রমিক; মহামারীতে আয় কমেছে দুজনেরই। সে কারণে উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলের অপেক্ষায় থাকা সুরভিকে কাজ শুরু করতে হয়েছে পোশাক কারখানায়।

সেইভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মহামারীর কারণে বিশ্বে ৯৭ লাখ শিশুর হয়ত আর ক্লাসে ফেরা হবে না।

এই তরুণী বলেন, “পেটের দায়েই কাজে নামছি। এবার অটো পাশ দিয়েছে ভালো হয়েছে, একটা সার্টিফিকেট তো হল। না হলে এমনিতে আর কলেজে যেতাম না, সহায়তা পেলে হয়ত যাব।”

স্কুল বন্ধ থাকায় ঢাকা আইডিয়াল প্রিপারেটরি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সিয়াম ইসলাম সজীব আসক্ত হয়ে পড়েছে ভিডিও গেইমে। খেলার খরচ যোগাতে মাঝে চাকরিতে যোগ দিয়ে অসুস্থ হয়ে তা ছেড়ে দেয় এই শিশু।

সজীবের মা আমেনা বেগম বলেন, “দিন দিন সে পড়াশুনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে দোকানে খেলতে যায়। সপ্তাহে দুই দিনও যদি ক্লাস হত তাহলে বাচ্চারা ভালো থাকত। স্কুল খুলতে দেরি হলে তাকে ক্লাসেই পাঠানো যাবে না।”

উপযুক্ত ডিভাইস না থাকায় সজীব অনলাইন ক্লাসেও অংশ নিচ্ছে না বলে জানান তিনি।

করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মধ্যে রাখতে টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার করা হচ্ছে।

তবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক সম্প্রতি এক জরিপে বলেছে, দেশের ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই টেলিভিশন ক্লাসের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

শিল্পী, ইমন, সুরভি ও সজীবের মতো শিক্ষার্থীদের সামনে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে তাদের ঝরে পড়া অনেকটা অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে গণস্বাক্ষরতার রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার যে কারণগুলো রয়েছে, মহামারীতে সেগুলোর ঝুঁকি আরও বাড়ছে।

“কোনো জরিপ বা তথ্য-উপাত্ত আমাদের কাছে নাই, আন্দাজ করে সবাই বলছেন। এ মুহূর্তে মাঠে গিয়ে জরিপ করাও সম্ভব না। আমরা ধারণা করছি, ৪০ ভাগের মতো শিশু ঝরে পড়তে পারে।”

এই উন্নয়ন কর্মী বলেন, “পরিবারের আয় কমে যাওয়া, খাদ্য ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রাথমিকে অনেকে ঝরে পড়বে। জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেক শিশু শ্রমে নেমে যাবে। মাধ্যমিকে এর সাথে যোগ হবে বাল্য বিয়ে।”

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত মে মাসে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত যে কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে, সেখানেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

আয় কমে যাওয়ায় আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারে বাল্যবিয়ে ও শিশু শ্রম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কাও উঠে আসে তাতে।

এই সংকট এখন বিশ্বব্যাপী, গত জুলাইয়ে সেইভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে ৯৭ লাখ শিশু আর ক্লাসে না ফেরার ঝুঁকিতে আছে, যাদের অনেকে বাল্যবিয়ের শিকার হবে।

বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে, অর্থনৈতিক সংকট ও দীর্ঘদিন স্কুলের বাইরে থাকায় অনেকেই ঝরে পড়বে বলে মনে করছেন সেভ দ্য চিলড্রেনের শিক্ষা উপদেষ্টা কামাল হোসেন।

জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ জুলাইয়ে এক গবেষণায় জানায়, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী অন্তত চার কোটি শিশু স্কুল শুরুর আগে প্রারম্ভিক শৈশবকালীন শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক শিশু আসক্ত হয়ে পড়েছে ভিডিও গেইমে

আর দক্ষিণ এশিয়ায় স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় ৪৩ কোটি শিশুর অনেকেরই ঝরে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে এপ্রিলে জানিয়েছিল সংস্থাটি।

এছাড়া আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও ইউনিসেফের এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ সংকটের ফলে লাখো শিশুকে শ্রমে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

ইউনিসেফের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ইকবাল হোসেন মনে করেন, মহামারী পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক সংকট বাড়ার পাশাপাশি ঝরে পড়ার হারও বাড়বে।

“দেশে সব সময় একটা বড় গ্রুপ ড্রপআউটের ঝুঁকিতে থাকে। শেষ পাঁচ বছরে এক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। এ গ্রুপটা হচ্ছে বিশেষ করে যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল।

“যতই আমরা বলি প্রাথমিক শিক্ষা ফ্রি, তারপরও অভিভাবকদের খরচ হয়। স্কুলে না দিয়ে কাজে পাঠালে এ বাচ্চারা কিছু আয় করতে পারে- যা অনেক পরিবারের বড় সাপোর্ট। এটা আগেই ছিল, কোভিডের কারণে আরও বাড়বে। আয় কমে যাওয়ায়, স্কুল বন্ধ থাকায় বাল্যবিয়ে বাড়বে। ছেলেদের কাজে যাওয়াও বাড়বে।”

কী কী কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলে ফিরবে না, সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করার তাগিদ দিয়েছেন ইউনিসেফের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ইকবাল হোসেন।

“সেগুলোকে টার্গেট করে যে সরকারি প্রোগ্রামগুলো আছে, সরকার যদি তা প্রচারণায় নিয়ে আসে, তাহলে আমরা যে ভয়টা পাচ্ছি তা কমিয়ে নিয়ে আসতে পারব।”

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, পরবর্তী পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য কী পরিমাণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে, তা বের করতে হবে।

“এটা পুনুরুদ্ধারে শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে। শিক্ষার অর্জনগুলো ধরে রাখতে হবে। শিক্ষার জন্য দরকার একটা প্রণোদনা প্যাকেজ। তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের জন্য বিকল্প পাঠের ব্যবস্থা করতে হবে। ঝরে পড়াদের বড় অংশ হবে যারা এখন কোনোভাবেই লেখাপড়ায় নেই।

“অন্যদের যদি সকালে একবার স্কুল হয়, তাদের সকাল-বিকাল করতে হবে। অথবা স্কুল আওয়ার বাড়িয়ে পরিকল্পনা করতে হবে, ছুটি কমিয়ে স্কুল ক্যালেন্ডারটা পুরো ঢেলে সাজাতে হবে।”

তবে দীর্ঘ বিরতিতে শিক্ষাব্যবস্থা যে সংকটে পড়েছে, তা সামলাতে মহামারীর মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে সেভ দ্য চিলড্রেনের শিক্ষা উপদেষ্টা কামাল হোসেন।

তিনি বলেন, “আমরা চাই শিশুরা ফিরুক স্কুলে, ফেরাটা যেন সেইফ হয়। সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে কোভিড পরিস্থিতিতে তাদের স্কুলে ফেরানো যাবে, এটা নিয়ে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার যে কারণগুলো রয়েছে, মহামারীতে সেগুলোর ঝুঁকি আরও বেড়েছে।

“শিশুদের পড়াশুনায় অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, এটা রিকভার করা অনেক চ্যালেঞ্জিং। এজন্য কিছু কমিউনিটি অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইন দরকার। এ বিষয়গুলো আমরা ‘সেইফ ব্যাক টু স্কুল’ কর্মকাণ্ডের মধ্যে হাইলাইটস করছি।”

স্কুল পর্যায়ে ঝরে পড়া বাড়লে সেটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

তিনি বলেন, “এই ড্রপআউট ম্যানেজ করার জন্য আমাদের এখন কোনো প্ল্যান নাই। এখন চ্যালেঞ্জটা হয়ে গেছে স্কুলগুলো খোলার বিষয়টা, শীতকালের পরপরই স্কুল খুলে দিতে হবে।”

স্কুল খোলার পর উপবৃত্তি ও বৃত্তি বাড়িয়ে দিলে ঝরে পড়া শিশুরা পুনরায় ফিরে আসবে বলে তিনিও মনে করেন।

এজন্য শিক্ষা খাতে খরচ সমন্বয়ের ভাবনার কথা জানান উপমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “অনেক এলাকায় স্কুল করার জায়গা নাই, তবু সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেসারে স্কুলে বিল্ডিং দিতে হচ্ছে। বিল্ডিং আর দরকার নাই তবুও অনেকে সংসদ সদস্য হিসেবে ‍দিতে চায়।

“এখন আমরা সার্ভে করে দেখব, কোন এলাকাতে কতগুলা বিল্ডিং হয়ে গেছে। যেহেতু এ টাকাটা আর ওদিকে লাগছে না, আমরা তখন সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে উপবৃত্তি বাড়ানো ও ‍পিছিয়ে পড়াদের উপর স্পেশাল অ্যাটেনশন দিয়ে তাদেরকে ট্রেনিং করানোর কাজ করতে পারব।”

২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ঝরে পড়া দ্রুত কমিয়ে ২০১৮ সালের মধ্যে সব শিক্ষার্থী যেন অষ্টম শ্রেণি শেষ করতে পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়।

গত কয়েক বছরে ঝরে পড়া কমে আসার পরও সরকারি হিসাবে গত বছর প্রাথমিক পর্যায়ে ১৭ দশমিক ৯০ শতাংশ ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।

এবার করোনাভাইরাস মহামারী এই সংখ্যা কোথায় নিয়ে যাবে, তাই এখন শঙ্কার বিষয়।