শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ফাদার টিমকে স্মরণ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ মানবতার কল্যাণে ছয় দশকের অবদানের কথা তুলে ধরে ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টিমকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2020, 02:07 PM
Updated : 23 Oct 2020, 03:06 PM

সদ্য প্রয়াত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ফাদার টিম স্মরণে শুক্রবার রাজধানীর শান্তিবাগে কারিতাস বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংস্থাটির আয়োজনে এই স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের সাউথ বেন্ডের হলি ক্রস হাউজে ৯৭ বছর বয়সে মারা যান বাংলাদেশে শিক্ষা বিস্তারে ও আর্ত মানবতার সেবায় ছয় দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করে যাওয়া ফাদার টিম।

ঢাকার নটরডেম কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদাতাদের একজন ছিলেন তিনি। তার হাত ধরেই বাংলাদেশের খ্যাতনামা এই কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার সূচনা হয়েছিল। তিনি এই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

স্মরণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা প্যাট্রিক ডি রোজারিও বলেন, “শুনলাম ফাদার টিম মারা গেছেন, তার মৃত্যুতেও আমি মনে করি তিনি বাংলাদেশে বেঁচে আছেন। তিনি চিন্তা জগতে জীবিত। সমাজ বিজ্ঞানে, ন্যায়, মানবাধিকার কর্মে, ত্রাণ কর্ম ও দয়ার কাজে তিনি জীবিত। সর্বজনের প্রিয় বন্ধু ও কর্মী হিসেবে তিনি জীবিত থাকবেন।”

সংসদ সদস্য আরোমা দত্ত বলেন, “ফাদার টিম বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নারী ও শিশুদের মর্যাদা, অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে তিনি এনজিও প্রতিষ্ঠান করেন। এর মাধ্যমে তিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন।”

ফাদার টিম সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষের সহযোগিতা করে গেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের পরও এই দেশের প্রান্তিক মানুষের দুর্দশা-দুর্গতি লাঘবে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করেন।”

নটরডেম কলেজের উপাচার্য ফাদার প্যাট্রিক গাফনি বলেন, “মানবতার জন্য কাজ করে গেছেন ফাদার টিম। আজীবন তিনি মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে গেছেন। ফাদার টিম সব সময় বিশ্বাস, আশা এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।”

ইনডিজেনাস পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেসের (আইপিডিএস) সভাপতি সঞ্জীব দ্রং বলেন, “ফাদার টিম পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে লিখে গেছেন। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি কাজ করে গেছেন। যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন তারা ফাদার টিমকে অনুসরণ করতে হবে।”

১৯৮২ সালে ফাদার টিমের সাথে প্রথম পরিচয় হয় জানিয়ে কারিতাস এশিয়ার প্রেসিডেন্ট বেনেডিক্ট আলো ডি রোজারিও বলেন, “আমি দেখেছি তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য উপকার করে গেছেন। সমাজের প্রথম শ্রেণির মানুষের সাথে তার যেমন সম্পর্ক ছিল, তার চেয়ে আরও বেশি আন্তরিক সম্পর্ক ছিল সমাজের প্রান্তিক মানুষদের সাথে। অবহেলিত-নিম্নবিত্ত মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন তিনি।”

বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য ফাদার টিমের ইচ্ছা থাকলেও তা আর হয়ে উঠেনি জানিয়ে আলো ডি রোজারিও বলেন, “নানা কারণে তিনি তা পাননি, এটা তার দুর্ভাগ্য।”

বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের প্রধান রোকেয়া কবির বলেন, “ফাদার টিম এই দেশকে সকল মানুষের দেশ করার জন্য বহু কাজ করেছেন। তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। তাকে আমরা সব সময় স্মরণ করবো।”

কারিতাস বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জের্ভাস রোজারিও সভাপতিত্বে এতে নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন ফ্রান্সিস রোজারিও স্বাগত বক্তব্যে দেন।

অন্যদের মধ্যে কারিতাস বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা হিউবার্ট লিটন গমেজ, রাজধানীর হলিক্রস কলেজের অধ্যক্ষ সিস্টার শিখা এল গোমেজসহ আরও অনেকে বক্তব্য দেন।

নটর ডেম কলেজের ষষ্ঠ অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফাদার টিম ১৯৫৫ সালে এই কলেজ সায়েন্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া কলেজটির ডিবেটিং ক্লাব ও নটর ডেম কলেজ অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবেরও প্রতিষ্ঠাতা তিনি। একাধারে একজন শিক্ষাবিদ, প্রাণিবিদ এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় কর্মী, বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত তৈরিতে কাজ করেন বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু।

ফাদার টিমের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায় ১৯২৩ সালের ২ মার্চ। তিনি বাংলাদেশে আসেন ১৯৫২ সালে। সাড়ে ছয় দশকের বেশি সময় বাংলাদেশে থেকে এদেশের শিক্ষার উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন ফাদার টিম।