চালকদের ডোপ টেস্ট করানোর পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর

মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো বন্ধে চালকদের ডোপ টেস্ট করানোর ব্যবস্থা নিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2020, 08:42 AM
Updated : 22 Oct 2020, 09:11 AM

বৃহস্পতিবার জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২০ উদযাপনের অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ট্রাফিক আইন মেনে চলারও পরামর্শ দেন এসময়।

চালকদের জন্য সড়কের পাশে বিশ্রামাগার তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা তাদের  ভালোমন্দ দেখতে মালিকদেরও প্রতি অনুরোধ রাখেন।

তিনি বলেন, “প্রাইভেট সেক্টর বা সরকারি..সবাইকে বলব আপনারা যদি স্পট ঠিক করে রাখেন, এই ড্রাইভারটা এত মাইল চলবে, তারপর সে সেখানে বিশ্রাম নেবে। ওখানে অলটারনেটিভ ড্রাইভার থাকবে। এইভাবে যদি আমরা ব্যবস্থা করতে পারি আমাদের দুর্ঘটনা আরও কমে যাবে।”

যারা গাড়ি চালাচ্ছে তারা মাদক সেবন করেন কিনা সেদিকে নজর রেখে তাদের ডোপ টেস্টের পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রত্যেকটা ড্রাইভারের এই পরীক্ষাটা একান্তভাবে অপরিহার্য। সেটাও আপনাদের করতে হবে।”

চালকদের ওভারটেক করার প্রবণতাও বন্ধের আহ্বান জানান তিনি।

পথচারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমরা শুধু ড্রাইভারদের কথা বলি, ড্রাইভারদের দোষ দেই। শুধু ড্রাইভারদের দোষ দিলে হবে না। পথচারীদেরও সচেতন থাকতে হবে। সেখানে সচেতনতার খুবই অভাব।

“আমরা মুখে খুব বলে টলে যাই, কিন্তু কাজের বেলা আমরা কি দেখি? পাশেই ফুটওভার ব্রিজ, রাস্তার মধ্যখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একটা গাড়ি আসছে একটু হাত দেখিয়েই হাঁটা দিল। এটা একটা যান্ত্রিক ব্যাপার। ব্রেক কষলেও সেটা থামতে কিন্তু কিছু সময় লাগে। হাত দেখালেই থেমে যেতে পারে না। সে কথাটায় সবাইকে সচেতন করতে হবে। সেটা প্রচার করতে হবে, বলতেও হবে, মানুষকে জানাতে হবে।”

সচেতনার অভাবে দুর্ঘটনা ঘটার উদাহরণ দিয়ে গাড়িচালকদের দোষ দেওয়ার প্রবণতার কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, “কেন ড্রাইভারকে দোষ দেব? দোষ তো ওই মায়ের, যে বাচ্চাকে নিয়ে যাচ্ছে বা আরেকজন বাবা দেখলাম বুকের মধ্যে বাচ্চাকে নিয়ে যেখানে রাস্তায় গ্রিল দেওয়া…গ্রিলের উপরে শার্প ইয়ে দেওয়া, সেটা পার হয়ে যাচ্ছে। একটু পা পিছলালে ওই শার্প নেইলটাতে বাচ্চা একদম ফুটো হয়ে যাবে।

“কাকে দোষ দেবে? সড়কের দোষ, সরকারের দোষ, আন্দোলন হবে সরকারের বিরুদ্ধে, সরকারের পদত্যাগ চাইবে কিন্তু দোষটা কার সেটা আর দেখবে না। এসব বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা আমাদের দেশে খুব বেশি প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।”

দুর্ঘটনা হলে গাড়িচালকদের মারধর করার বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “মারতে মারতে মেরেই ফেলে দিল। কিন্তু বিচার করলে না যে কার দোষে অ্যাকসিডেন্টটা হল। বেচারা ড্রাইভার জীবনটা দিল কিন্তু এর ফলাফলটা কি দাঁড়াচ্ছে..ফলাফলটা এই দাঁড়াচ্ছে যে একজন হয়তো ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। মার খাওয়ার ভয়ে, প্রাণের ভয়ে ড্রাইভার কিন্তু গাড়ি চালিয়ে গেল। তার উপর দিয়ে যদি গাড়ি না যায় সে কিন্তু বেঁচে যায়। কিন্তু যেহেতু ড্রাইভারের উপর আক্রমণ হবে, যেহেতু ড্রাইভারকে মার খেতে হবে পাবলিকের, সেজন্য ড্রাইভার আর কিছু তখন দেখে না। সোজা গাড়ি চালায়।”

চালকদের ওপর হাত না দেওয়ার অনুরোধ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কেউ গাড়ি আক্রমণ করবেন না। যদি ড্রাইভাবের দোষ হয়, আইন আছে। আইন তার ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু আইন কেউ হাতে তুলে নেবেন না। এই আইন হাতে তুলে নেবার কারণে অনেক মানুষ কিন্তু মারা যায়।”

নিরাপদ সড়ক নিয়ে যারা আন্দোলন করেন তাদের এই ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরির আহ্বানও জানান তিনি।

দেশের সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে আমি অনুরোধ করব, সড়ক যোগাযোগে যেমন নিরাপত্তা প্রযোজন, সেই সাথে সড়ক নির্মাণ করার সময় আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্যটা যেন বজায় থাকে সেটার দিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে কালভার্ট করতে হয়, ব্রিজ করতে হয়।

তিনি বলেন, “আমাদের মাটি হচ্ছে দোআঁশ মাটি। এই মাটিতে কোনো কিছু তৈরি করতে গেলে কিন্তু খরচ অনেক বেশি। সড়ক নির্মাণের সময় অনেকে প্রশ্ন তোলেন অমুক দেশে এত কম তাহলে আমাদের দেশে কেন এত বেশি।তাদেরকে অনুরোধ করব আমাদের মাটিটা আপনারা একটু পরীক্ষা করে দেখবেন। আর যে দেশের কথা বলবেন তাদের মাটিটাও পরীক্ষা করে আপনারা দেখবেন যে সেখানে সড়ক নির্মাণ করতে কত খরচ হয় আর আমাদের দেশে কত খরচ হয়। কাজেই এগুলোও কিন্তু আমাদের বিবেচনা করতে হবে। অহেতুক দোষ দিলে হবে না। বাস্তবতাটাও মেনে নিতে হবে।”

রাজধানীর সাথে সারাদেশে যোগাযোগের নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সরকার কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা ঢাকা বা তার আশপাশের এলাকায় আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিতে ছয়টি মেট্রোরেলের আওতায় ১২৮.৭৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১০৪টি স্টেশন বিশিষ্ট একটি শক্তিশালী সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কার্যক্রম আমরা শুরু করেছি। ৬৭.৫৬৯ কিলোমিটার উড়াল এবং ৬১.১৭২ কিলোমিটার পাতাল মেট্রোরেল নির্মাণ হবে এবং ৫১টি স্টেশন হবে উড়াল এবং ৫৩টি স্টেশন হবে পাতাল। মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকা ও পাশ্ববর্তী জেলার যানজটও কমবে।”

আওয়ামী লীগ প্রথম সরকার গঠনের পর বিআরটিসির জন্য প্রায় এক হাজারের মতো বাস কেনা হয়েছিল জানিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের দুর্ভাগ্য বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সেগুলো কোথায় কাকে দিয়ে ধ্বংস করে। আর দ্বিতীয়বার যখন আমরা আসলাম তখন তাদের অগ্নিসন্ত্রাসের কারণে প্রায় ৬০০ বিআরটিসি বাস, ট্রাক এবং প্রাইভেটকারসহ প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার গাড়ি তারা পুড়িয়ে দিয়েছিল।

“আমরা কষ্ট করে কিনে নিয়ে আসি মানুষের সুবিধার জন্য আর তারা ধ্বংস করে আন্দোলনের জন্য। মানুষকে পুড়িয়ে মারা এবং জাতীয় সম্পদগুলোকে ধ্বংস করা, সেগুলো পর্যন্ত তারা করেছে।”

সরকার ৬০০ নতুন বাস, ৫০০ নতুন ট্রাক বিআরটিসিতে সংযোজনের পাশপাশি ৬২৯টি দোতলা বাস এবং ২৮৭টি এসি বাসের মাধ্যমে নাগরিকদের সুবিধা নিশ্চিত করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদ যাতায়াতের জন্য ১৮৮টি বাস ব্যবহার করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “অনেক স্কুলকে আমি অনুরোধ করেছিলাম তাদের বাস লাগবে কিনা, বিশেষ করে প্রাইভেট স্কুলগুলো। অনেকেই রাজি না। আর কিছু কিছু বাবা-মায়েরা একটু পয়সাওয়ালা হয়ে গেছে, বিভিন্ন ব্রান্ডের গাড়ি চড়ে। তাদের ছেলে-মেয়েরা ওই গাড়ি থেকে নামবে…গাড়ি থেকে নেমে স্কুলের বন্ধুকে বলবে জানিস আজকে আমি কোন গাড়িতে এসেছি। সেই কথা বলার সুযোগ পাবে না বাসে গেলে।

“অহমিকা বোধটাও মানুষের ক্ষতি করে, যানজটও বাড়ায়। এটাও একটা দুর্ভাগ্যের বিষয়। হাজার টাকার মালিক কাজেই এটাতো দেখাতেই হবে। এই দেখাতে গিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং ট্রাফিকটাও বাড়ায়।”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালসহ বিশিষ্টজনেরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে সংযুক্ত ছিলেন।

গণভবন প্রান্ত থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বনানীর বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) মিলনায়তন প্রান্তে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি একাব্বর হোসেন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।