মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়ন নিয়ে ‘উদ্বিগ্ন’ আলেমরাও

দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্যেই বিভিন্ন মাদ্রাসায় একের পর এক যৌন নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশে উদ্বেগ জানিয়েছেন শীর্ষস্থানীয় আলেমরাও।

মিন্টু চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2020, 03:59 PM
Updated : 21 Oct 2020, 03:59 PM

দারিদ্র্য ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে মাদ্রাসা ছাড়া করার ভয় দেখিয়ে শিশু শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো অপকর্ম চেপে যেতে বাধ্য করার বিষয়টি সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে।

গত দশ দিনে চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা এবং জেলার রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া ও বাঁশখালী উপজেলায় কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর এমনই তথ্য মিলেছে।

অতীতে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকদের শিশু ধর্ষণসহ বিভিন্ন ঘটনার প্রমাণ মিললেও তা প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সে কারণে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

মূল্যবোধ, নৈতিক অবক্ষয় এবং পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার অভাবকে এর জন্য দায়ী করে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের অপকর্ম রোধ করা যেতে পারে বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।

কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শীর্ষস্থানীয় আলেমরাও বিষয়টি নিয়ে ‘উদ্বিগ্ন’। তারা এ ধরনের কোনো ঘটনাকে সমর্থন করেন না এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ‘নেওয়া হবে’ বলে জানিয়েছেন।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি নানুপুর মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শীর্ষস্থানীয় আলেম মাওলানা সালাউদ্দিন নানুপুরী বলেন, “বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এতে আমরা উদ্বিগ্ন। মাদ্রাসা শিক্ষা এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনাকে সমর্থন করে না।”

গত সোমবার রাঙ্গুনিয়া স্বনির্ভর এলাকায় চার শিশু ছাত্রকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় আহমদিয়া আজিজুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক নাছির উদ্দিনকে (৩৫)। তিনি ওই কওমি মাদ্রাসাটির হোস্টেল সুপার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন।

মধ্যপ্রাচ্যফেরত নাছির দুই বছর আগে রাঙ্গুনিয়ার ওই মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানকার শিশু ছাত্রদের প্রায় প্রত্যেক রাতে যৌন নিপীড়নে বাধ্য করতেন বলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।

গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বিভিন্ন সময়ে শিশু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করার বিষযটি স্বীকার করেছেন নাছির। এছাড়া শিশু শিক্ষার্থীদের পরিবারের দারিদ্র্য ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এবং ভয় দেখিযে এ ধরনের অপকর্মে বাধ্য করার বিষয়টিও বলেছেন।

তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি চার শিশুর অভিভাবক থানায় অভিযোগ করার পর ওই মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে নাছিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পুলিশের রাঙ্গুনিয়া সার্কেলের এএসপি আনোয়ার হোসেন শামীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই গরিব। কারও বাবা দিনমজুর, রিকশাওয়ালা অথবা কারও মা গার্মেন্টকর্মী। কম খরচে খাদ্যের নিরাপত্তা ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করানোর জন্য দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠানো হয়।

“প্রায় প্রতি রাতেই ওই শিক্ষক ভয় দেখিয়ে শিশু ছাত্রদের যৌন কর্মকাণ্ডে বাধ্য করতেন। যারা রাজি হত না তাদের ব্যাপক মারধরের পর মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হত। এক প্রকার বাধ্য হয়েই দরিদ্র পরিবারের এসব শিশু সন্তানরা অনৈতিক কাজে লিপ্ত হত বলে জিঞ্জাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাঙ্গুনিয়া থানার একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দীর্ঘদিন মাদ্রাসায় এসব বিষয় নিয়ে কোনো তদারকি না থাকায় এবং শিক্ষার্থীদের পরিবারের অসহায়ত্বের সুযোগে দুই বছর ধরে এ অপকর্ম করার সুযোগ পেয়েছে নাছির।

এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অভিভাবকদের নিয়মিত খবরাখবর রাখার ওপরও জোর দেন তিনি।

দুই বছর ধরে ওই মাদ্রাসায় নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও কেউ ভয়ে মুখ খোলেনি। নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছার পর ওই মাদ্রাসার পাঁচ শিশু শিক্ষার্থী গত রোববার পালিয়ে এসে পরিবারের সদস্যদের জানালে বিষয়টি অভিভাবকদের নজরে আসে এবং থানায় মামলা হয়।

মাদ্রাসা শিক্ষক নাছিরের নিপীড়নের শিকার হওয়া এক শিশুর ভ্যানচালক বাবা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা গরিব, তাই ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছিলাম একজন ভালো হাফেজ হবে এই আশায়। ওই শিক্ষকের নির্যাতনে পাঁচজন পালিয়ে এসে আমাদের জানালে থানায় গিয়ে অভিযোগ করি। আমরা তার শাস্তি চাই।”

এদিকে মঙ্গলবার সকালে পতেঙ্গা থানা এলাকার একটি মাদ্রাসার দুই শিক্ষককে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মুসলিমাবাদ এলাকার জমিয়তুল মাদ্রাসার ওই দুই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান ওসি জোবায়ের সৈয়দ।

মাদ্রাসার পাশের একটি বাসার পাঁচ বছর বয়সী ওই ছেলে শিশুকে সোমবার রাতে ফুঁসলিয়ে ডেকে নিয়ে যৌন নিপীড়ন করা হয় বলে অভিযোগ।

ওসি বলেন, “এদের একজন যৌন নিপীড়ন করে এবং অপরজন তাকে সহযোগিতা করেছে। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ আসলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।”

গত ১২ অক্টোবর রাতে পটিয়া উপজেলার গোবিন্দারখীল এলাকায় ১৩ বছরের এক ছেলেকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় কামরুল ইসলাম নামের এক মাদ্রাসা শিক্ষককে।

গত ১৯ অক্টোবর বাঁশখালী উপজেলার চাম্বলে ১১ বছর বয়সী এক মাদ্রাসার ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মোজাম্মেল হক নামে অপর এক মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তিনি এখন পলাতক রয়েছেন।

যৌন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান জানিয়ে মাওলানা সালাউদ্দিন নানুপুরী বলেন, “আমরা এ ধরনের ঘটনাকে কখনোই সমর্থন করি না। আমরা এর নিন্দা জানাই। যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়নের নিন্দা জানিয়ে হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সদস্য মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া বলেন, “বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। প্রকৃত ইসলামি শিক্ষায় এসব নেই।

“যাদের প্রকৃত ইসলামি শিক্ষা নেই তারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। যাদের ইসলামের এলেম আছে তারা এ ধরনের জঘন্য কাজ কখনও করতে পারে না।”

কয়েকটি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনার’ মধ্য দিয়ে ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার ‘চেষ্টা করা হচ্ছে’ মন্তব্য করে এই হেফাজত নেতা বলেন, “নিজেদের মাওলানা দাবি করা অনেকেই অশিক্ষিত আছেন। তারা ভালো লোক না।”

যেখানে নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়, সেই মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়নের ঘটনা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন শোকালিয়া ঈদ জামাতের ইমাম মাওলানা ফরীদউদদীন মাসঊদ ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সমাজের সব জায়গাতেই নানা ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। নৈতিকতার অভাব, মানুষের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করতে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।”

বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার সভাপতি মাওলানা মাসঊদ বলেন, “শুধু মাদ্রাসায় নয়, খ্রিস্টানদের গির্জা, হিন্দুদের মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিচ্ছিন্নভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এটা নিন্দনীয়।

“সেখানে নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়। তার বদলে এ ধরনের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। সর্ষের মধ্যেও ভূত রয়েছে।”

এ ধরনের ঘটনা রোধের জন্য আইন প্রয়োগের পাশাপাশি মাদ্রাসা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে আরও সতর্ক ও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

ধর্ষণ-যৌন নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ওবায়দুল করিম বলেন, “প্রত্যেকটা সমাজে কিছু নিয়মকানুন থাকে, মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু আদর্শ, মূল্যবোধ, নৈতিকতাবোধ, ধর্ম থাকে। এসব যদি পরিবার থেকে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সঠিকভাবে গড়ে না ওঠে একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে না।

“আমাদের সমাজে এসব বিষয়ের চর্চা কমে যাচ্ছে। স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধীরে ধীরে তা কমছে।”

মাদ্রাসাগুলোতে এ ধরনের ঘটনার পেছনে সেখানে যথাযথ নজরদারির ঘাটতির কথা বলেছেন এই অধ্যাপক।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুপারভিশনও হচ্ছে না ঠিকমতো। ধর্মীয় শিক্ষাও হয়ত যথাযথ হচ্ছে না কোথাও। ধর্মীয় আচরণে বিশ্বাস থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটার কথা না।”

এসব ঘটনায় আইনের কঠোর প্রয়োগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, “এতে করে অপরাধ করার প্রবণতা কমে আসতে পারে।”