পি কে হালদার দেশে নামা মাত্র গ্রেপ্তারের নির্দেশ

দুদকের চোখে ৩০০ কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদের’ মালিক পি কে হালদার বিমান থেকে দেশের মাটিতে পা রাখার সাথে সাথে তাকে গ্রেপ্তার করে উপযুক্ত আদালতে সোপর্দ করতে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2020, 10:38 AM
Updated : 21 Oct 2020, 01:42 PM

তিনি যাতে ‘নিরাপদে’ দেশে ফিরে আত্মসমর্পণ করতে পারেন, সেজন্য পুলিশ প্রধান, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আদালত আদেশে বলেছে, আগামী ২৫ অক্টোবর সকাল ৮টা ১০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে (ইকে৫৮২) দেশে ফেরা মাত্র পি কে হালদারের গ্রেপ্তার করে উপযুক্ত আদালতে সোপর্দ করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করতে বলা হচ্ছে ওই তিন কর্তৃপক্ষকে।

প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার)

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের জীবনের নিরাপত্তায় আদালতের হেফাজত চেয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) আবেদন গ্রহণ করে বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেয়।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। আইএলএফএসএল-এর আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিলন। আর দুদকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন মো. খুরশীদ আলম খান।

প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার)প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার)আদেশে বিচারক বলেন, “পি কে হালদার যদি দেশে আসেন, তাহলে এই কোম্পানি মেটারটা নিষ্পত্তি করা যাবে। সেটা নিষ্পত্তি করার জন্য এই কোর্ট দেখতে চায় যে, তিনি বিমানযোগে দেশে পা ফেলা মাত্র তাকে যেন অ্যারেস্ট করা হয় এবং জেলে নেওয়া হয়। তাকে যেন বাইরে যেতে না দেওয়া হয়।

“এই কাজটা যদি করা হয়, তাহলে তার আবেদন অনুযায়ী তিনি যে মনে করছেন, তাকে কিডন্যাপ করা হবে, তা আর হবে না।”

আদালত বলেছে, গ্রেপ্তার হওয়ার পরও কোম্পানির বিভিন্ন বৈঠকে থাকতে পারবেন পি কে হালদার। ডেসটিনির মামলায় এ বিষয়ে আপিল বিভাগের একটি নির্দেশনা আছে। প্রয়োজনে তার চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে।

আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনি (পি কে হালদার) যেহেতু একজন পলাতক আসামি, তাই তিনি আইনের কোনো আশ্রয় পেতে পারেন না। আর সরাসরি যেটা তিনি করতে পারেন না, সেটা অন্যের মাধ্যমেও করতে পারেন না।

“আমার বলেছি, তিনি যদি বাংলাদেশে আসেন, আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যেহেতু তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে, তাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করবে। পরে অবশ্য কোর্টও এই নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে অ্যারেস্ট করতে হবে।”

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, “আইএলএফএসএল দরখাস্ত দিয়েছিল যেন পি কে হালদার সেইফভাবে বাংলাদেশে আসতে পারে এবং তার সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারে। তার বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখারও আবেদন করেছে।

“আমরা বলেছি, উনি অনেক কিছুই চেয়েছেন, কিন্তু পলাতক থেকে মামলার কার্যক্রম স্থগিত চাওয়া, এটা আমাদের ইতিহাসে কোথাও নাই। আদালতও এই প্রেয়ার গ্রহণ করেননি।”

আদালতের আদেশ থেকে উদ্ধৃত করে খুরশীদ আলম খান বলেন, “বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তিনি সোপার্দ হবেন। সেখান থেকে দুদকের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে এবং জেলহাজতে নিয়ে যাওয়া হবে। তিনি আইনের হেফাজতে চলে যাবেন নামার সঙ্গে সঙ্গে।

“এই পুরো প্রক্রিয়া হলফনামা আকারে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকে জানাতে হবে। তারপর তিনি (পি কে হালদার) কোম্পানি কোর্টের কাজে সহযোগিতা করবেন। কোর্টের আদেশের মূল উদ্দেশ্য হল, পাওনাদারদের টাকা কীভাবে, খুব নিরাপদে তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া যায়।”

ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) টাকা উদ্ধারে সহযোগিতা করতে নিরাপদে দেশে ফিরতে চান আইনের দৃষ্টিতে পলাতক পিকে হালদার।

আইএলএফএসএলের পক্ষ থেকে হাই কোর্টে করা আবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২৫ অক্টোবর দুবাই থেকে এমিরেটস এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আসার জন্য তিনি টিকিট কেটেছেন। বাংলাদেশ সময় সকাল ৮টা ১০ মিনিটে ওই ফ্লাইট ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার কথা রয়েছে।

এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর এই বেঞ্চে এ সংক্রান্ত আরেকটি আবেদন করেছিল আইএলএফএসএল। সেদিন আদালত বলেছিল, পি কে হালদার কবে, কখন, কোন ফ্লাইটে দেশে ফিরতে চান, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানালে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ও দুদকসহ দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে।

শুনানিতে বিচারক এও বলেছিলেন, আত্মসাতকারীরা টাকা ফেরত দিতে চাইলে সে সুযোগ যেমন থাকা দরকার, তেমনি তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখাও প্রয়োজন।

বিদেশে থাকা পিকে হালদার গত ২৮ জুন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে একটি আবেদন করেন। সেখানে বলা হয়, আইএলএফএসএল তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মালিকানার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। তার অনুপস্থিতি ও দেশের মধ্যে সৃষ্ট ‘অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে’ ওইসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ‘জটিল আকার’ ধারণ করেছে।

তিনি দেশে ফিরতে পারলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘সঙ্কট কেটে যাবে’ এবং মহামারীর সময়ে দেশের অর্থনীতিতে ‘ইতিবাচক ভূমিকা’ রাখতে পারবে বলে সেখানে দাবি করা হয়।

আবেদনে বলা হয়, সেজন্য তিনি ‘ভয়ভীতিমুক্ত পরিবেশে’ দেশে ফিরতে চান এবং তার সব প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে আইএলএফএসএলসহ অন্যান্য সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দায়দেনা মিটিয়ে ফেলতে চান।

পি কে হালদারের ওই আবেদন পাওয়ার পর তার জীবনের নিরাপত্তায় আদালতের হেফাজত চেয়ে আবেদন করে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) ।

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিকে হালদার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা লোপাট করে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান বলে চলতি বছরের শুরুতে খবর আসে।

এরপর আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের পাশাপাশি তার সম্পত্তি জব্দ করা হয়। তার বিরুদ্ধে ৩০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক।

এর আগে আইএলএফএসএলে রাখা আমানতের টাকা ফেরতের নির্দেশনা চেয়ে সাত ব্যক্তি হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন। ওই আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট গত ২১ জানুয়ারি পি কে হালদার, তার মা, স্ত্রী, ভাই এবং ওই কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ১৯ জনের পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ দেয়।

তাদের দেশত্যাগ ঠেকাতে ওই নির্দেশ দেওয়া হলেও পি কে হালদার ততদিনে লাপাত্তা হয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর আসে।

আদালত সে সময় আরও নির্দেশ দিয়েছিল, এ সংক্রান্ত বিচারাধীন মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পি কে হালদার ও তার সঙ্গীদের নগদ অর্থ, গাড়ি, মজুদসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কোনও ব্যক্তি বা সত্তার কাছে হস্তান্তর করা যাবে না।

হাই কোর্টের সে আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আপিল বিভাগে আবেদন করেন আইএলএফএসএল এর দুই পরিচালক।

পরে ২৬ ফেব্রুয়ারি তাদের সেই আবেদন খারিজ করে দিয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারকের আপিল বেঞ্চ হাই কোর্টের আদেশই বহাল রাখে।

পুরনো খবর