বদলে যাওয়া ভাসান চর রোহিঙ্গাদের অপেক্ষায়

সাগরের মাঝখানে এক টুকরো সবুজ দ্বীপ,তারই মাঝে লাল রঙের ছাউনি দেওয়া চতুর্ভুজ আকৃতির সারি সারি টানা ঘর আর সাদা রংয়ের বহুতল ভবন মিলিয়ে পরিকল্পিত এক জনপদ; ‘ভাসান চর’ নাম শুনলে ধু ধু বালুচরের যে ছবি মনে ভাসে, তার সঙ্গে এর মিল নেই।

রিয়াজুল বাশার ভাসান চর থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Oct 2020, 05:22 PM
Updated : 1 Nov 2020, 04:19 AM

নোয়াখালীর হাতিয়া থানাধীন চর ঈশ্বর ইউনিয়নের অধীন মোটামুটি ১৩ হাজার একর আয়তনের এই দ্বীপ এখন মানুষের বসবাসের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। 

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে সাময়িকভাবে স্থানান্তরের জন্য এই ভাসান চরকে সাজিয়ে তুলতে খরচ হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি।

এক লাখ রোহিঙ্গার থাকা আর রান্নার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি আর পয়ঃনিষ্কাশন, খেলার মাঠ আর ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহের সুযোগও সেখানে তৈরি করা হয়েছে।

কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তি আর রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণে এখনও সেই স্থানান্তর শুরু করতে পারেনি সরকার।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তি কোথায়? তাদের উদ্বেগের একটি কারণ ভাসান চরের ভৌগলিক অবস্থান। তারা বলছে, সাগরের মাঝে বিচ্ছিন্ন ওই দ্বীপে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে রোহিঙ্গারা কতটা নিরাপত্তা পাবে, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নয়।

তাছাড়া সেখানে রেহিঙ্গাদের জন্য জরুরি সব মানবিক চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থা থাকছে কি না- সে বিষয়েও নিশ্চিত হতে চায় তারা।

কক্সবাজার থেকে ইতোমধ্যে ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে ভাসানচরের আশ্রায়ন প্রকল্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এই উদ্বেগ নিরসনে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ভাসান চরে?

ভাসান চর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলছেন, গত ১৭৬ বছরের মধ্যে কোনো ঘূর্ণিঝড় এই দ্বীপের ওপর দিয়ে অতিক্রম করেনি। সবচেয়ে কাছে যেটি এসেছে, সেটাও আসলে ৩৬ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল।

“এক লাখ রোহিঙ্গার সাময়িক আশ্রয়ের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা ভাসান চরে করা হয়েছে। ঢেউ ও জোয়ারের ধাক্কা থেকে তীর রক্ষার জন্য শোর প্রটেকশন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একটু ভালোভাবে থাকার জন্য যে সুযোগ সুবিধাগুলো এখানে রাখা হয়েছে, সেগুলো কক্সবাজারের ক্যাম্পে নেই।”

কী আছে ভাসান চরে?

ভাসান চরের প্রকৃত পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে একদল সাংবাদিককে গত সপ্তাহে হাতিয়ার ওই দ্বীপে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। 

কক্সবাজারের ঘিঞ্জি ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবন যারা দেখেছেন, ভাসান চরের ব্যবস্থাপনা ও সুযোগ সুবিধাগুলো ঘুরে দেখার পর তিনি স্বীকার করবেন যে, প্রকল্প পরিচালক মোটেও বাড়িয়ে বলেননি।  

১৩ হাজার একর আয়তনের এই দ্বীপের মধ্যে ১৭০২ একর জমির চারপাশে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে জোয়ার ও জলোচ্ছাসের ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য।

এর ভেতরেই রোহিঙ্গাদের আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনার জন্য ৪৩২ একর এবং ভবিষ্যতে প্রকল্পের সম্প্রসারণ ও বনায়নের কাজে ৯১৮ একর এলাকা রাখা হয়েছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রতিটি কক্ষে রয়েছে চারজনের একটি পরিবারের থাকার ব্যবস্থা।

ভাসান চরে আশ্রয়ন-৩ প্রকল্পটি গড়ে উঠেছে মূলত ক্লাস্টার হাউজ ও শেল্টার স্টেশন মিলিয়ে গুচ্ছ গ্রামের আকারে। ক্লাস্টার হাউজ ও শেল্টার স্টেশনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে ভূমি থেকে চার ফুট উঁচু করে, কংক্রিটের ব্লক দিয়ে।

প্রতিটি ক্লাস্টারে রয়েছে ১২টি হাউজে। পাকা দেয়ালের ওপর টিনের শেডের প্রতিটি হাউজে রয়েছে ১৬টি করে কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে চারজনের এ্কটি পরিবারের থাকার ব্যবস্থা।

জাতিসংঘের আদর্শ মান অনুযায়ী, আবাসনের ক্ষেত্রে যেখানে মাথাপিছু ৩৭ বর্গফুট জায়গার কথা বলা হয়েছে, এসব কক্ষে তার চেয়ে বেশিই জায়গা রাখা হয়েছে বলে প্রকল্প পরিচালক জানালেন

প্রতিটি ক্লাস্টারের জন্য রয়েছে একটি করে চারতলা কম্পোজিট স্ট্রাকচারের শেল্টার স্টেশন। এই শেলটার স্টেশন ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার গতিবেগের ঘূর্ণিঝড়েও টিকে থাকতে সক্ষম।

এরকম মোট ১২০টি ক্লাস্টার এবং ১২০টি শেলটার স্টেশন নিয়েই গড়ে উঠেছে ভাসান চরের আশ্রয়ণ প্রকল্প, যা সরকারিভাবে আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩ নামে পরিচিত। 

প্রতিটি হাউজে বসবাসকারী নারী-পুরুষদের জন্য রয়েছে আলাদা গোসলখানা ও টয়লেট। সেই সঙ্গে আলাদা রান্নাঘরের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

প্রতিটি হাউজে বসবাসকারী নারী-পুরুষদের জন্য রয়েছে আলাদা গোসলখানা ও টয়লেটের ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে আলাদা রান্নাঘরের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আছে পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেনের ব্যবস্থা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য রয়েছে কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগার।

এছাড়া প্রতিটি হাউজের ছাউনির ওপর রয়েছে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল। ঘরে আছে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা।

এ প্রকল্পে শিশুদের জন্য দুটি খেলার মাঠ তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসেও খোলা জায়গা আছে খেলার জন্য।

রয়েছে এতিমখানা, ডে-কেয়ার, সুপারশপ, সেলুন, মসজিদ ও বাজার। প্রতিটি ক্লাস্টারে একটি করে পুকুর এবং প্রকল্প এলাকায় বেশ কিছু লেক ও পুকুর কাটা হয়েছে। 

দ্বীপের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য সেবার জন্য ২০ শয্যার দুটি হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক করা হয়েছে।

সরকারি কর্মকর্তা, জাতিসংঘ প্রতিনিধি, আরআরআরসি প্রতিনিধি, রেডক্রস, আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিনিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে।

ভাসান চরের পাশ দিয়ে জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্য ৯১ ফুট উঁচু এই বাতিঘর নির্মাণ করা হয়েছে, যা ১৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত নেভিগেশন সুবিধা দিতে পারবে।

কেন ভাসান চর

গত কয়েক দশকে মিয়ানমারে দমন-নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়ে ছিল কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইনের গ্রামে গ্রামে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের ঢল নামে।

এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে গড়ে উঠেছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। জাতিসংঘের নেতৃত্বে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের এই নাগরিকদের জরুরি চাহিদাগুলো পূরণ করার চেষ্টা করে আসছে।  

সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, কক্সবাজারের ওই ক্যাম্পগুলোতে মোটামুটি সাড়ে ছয় হাজার একর জমিতে এখন আট লাখ ৬০ হাজারের মত রোহিঙ্গার বসবাস।

প্রতি বর্গকিলোমিটারে কোনো কোনো অংশে ৩০-৪০ হাজার মানুষকেও থাকতে হচ্ছে সেখানে। এই ঘনবসতির মধ্যে তাদের যেমন মানবেতন জীবন যাপন করতে হচ্ছে, তেমনি স্থানীয়ভাবে নানা সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে।

সে কারণে তাদের একটি অংশকে অন্যত্র স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার। সেজন্য বেছে নেওয়া হয় হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনায় ভাসান চরকে।

আকাশ থেকে দেখা ভাসান চরের আশ্রয়ন-৩ প্রকল্প। এটি গড়ে তোলা হয়েছে ক্লাস্টার হাউজ ও শেল্টার স্টেশন মিলিয়ে গুচ্ছ গ্রামের আদলে। ক্লাস্টার হাউজ ও শেল্টার স্টেশনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে ভূমি থেকে চার ফুট উঁচু করে, কংক্রিটের ব্লক দিয়ে।

জনমানবহীন চরটি আগে মূলত গরু-মহিষের চারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হত। ২০১৩ সালে এ চরকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকা ঘোষণা করা হয়েছিল।

ভৌগলিকভাবে ভাসান চরের অবস্থান সন্দ্বীপ ও হাতিয়ার মাঝখানে। সন্দ্বীপ থেকে এর দূরত্ব সাড়ে চার নটিক্যাল মাইল পশ্চিমে এবং হাতিয়া থেকে ১৩ নটিক্যাল মাইল পূর্বে।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচলকারী জাহাজগুলো ভাসান চরের পাশের চ্যানেল ব্যবহার করে। ইঞ্জিন বোটে চট্টগ্রামের মূল ভূখণ্ড থেকে ভাসান চরে যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টার মত।

২০১৭ সালের নভেম্বরে আশ্রয়ন-৩ প্রকল্প একনেকের অনুমোদন পাওয়ার পর নৌবাহিনীর মাধ্যমে ভাসান চরে শুরু হয় প্রকল্পের বাস্তবায়ন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব এ প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক হিসাবে সার্বিক অগ্রগতি মনিটরিং ও পর্যালোচনা করেন।

প্রকল্প পরিচালক জানান, সাগরের ঢেউ আর জোয়ার থেকে রক্ষায় দ্বীপ ঘিরে ৯ ফুট উচ্চতার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, যা পরে ১৯ ফুট উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হবে।

সেই সঙ্গে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য দ্বীপের চারপাশে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হচ্ছে। 

পণ্য পরিবহন ও মানুষ পারাপারের সুবিধার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে জেটি। বসানো হয়েছে তিনটি মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক টাওয়ার। ফলে যোগাযোগ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা থাকছে না।

ভাসান চরের প্রতিটি হাউজের ছাউনির ওপর স্থাপন করা হয়েছে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল। দ্বীপের বাসিন্দাদের চাহিদা মেটাতে এসব প্যানেল থেকে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এছাড়া তেলচালিত জেনারেটর থেকে আরো দুই মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা হবে।

দ্বীপের বাসিন্দাদের চাহিদা মেটাতে সৌর বিদ্যুত থেকে এক মেগাওয়াট এবং তেলচালিত জেনারেটর থেকে আরো দুই মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।

খাদ্য সংরক্ষণের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে চারটি গুদাম, যাতে এক লাখ মানুষের তিন মাসের খাবার সংরক্ষণ করা সম্ভব।

ভাসান চরের পাশ দিয়ে জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্য ৯১ ফুট উঁচু একটি বাতিঘর নির্মাণ করা হয়েছে, যা ১৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত নেভিগেশন সুবিধা দিতে পারবে। 

বর্তমানে ভাসান চরে ৩০৬ জন রোহিঙ্গা আছেন, যাদের চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশের জলসীমা থেকে উদ্ধার করে ওই দ্বীপে নিয়ে রাখা হয়।

কক্সবাজারের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের এই আশ্রয়ন প্রকল্পের সুযোগ সুবিধাগুলো দেখাতে কিছুদিন আগে ৪০ জনের একটি দলকে ওই দ্বীপ ঘুরিয়ে দেখানো হয়।

ফিরে গিয়ে তারা জানান, সব কিছু দেখে তাদের ভালো লেগেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তিতে স্থানান্তরের বিষয়টি এখনও থমকে আছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সম্প্রতি সাংবদিকদের বলেন, ইউএনএইচসিআর এবং এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের ওপর ‘চাপ রয়েছে’, যেন রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে পাঠানো না হয়।

এ বিষয়ে ই মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের কমিউনিকেশনস অফিসার লুইস ডোনোভান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভাসান চরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে সার্বিক পরিস্থিতি বুঝতে এবং তাদের মানবিক চাহিদাগুলোর পাশাপাশি নিরাপত্তার ব্যবস্থাগুলো দেখতে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এ বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকেও জানানো হয়েছে।   

এক্ষেত্রে শর্তগুলো কেমন হবে তা সরকারকে বলা হয়েছে জানিয়ে লুইস ডোনোভান বলেন, তারা এখনও সরকারের উত্তরের অপেক্ষায় আছেন।

“এক্ষেত্রে জাতিসংঘের অবস্থান বরাবরের মতোই। আমরা বলে আসছি, স্থানান্তরের আগে ভাসান চরের জীবনমান ও নিরাপত্তার বিষয়ে অবশ্যই বিস্তারিত কারিগরি মূল্যায়ন হতে হবে। আর রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়টি হতে হবে স্বেচ্ছায়।”

কয়েক হাজার মহিষ নিয়ে ভাসান চরে গড়ে তোলা হয়েছে খামার।

কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে ভাসান চর ভালো?

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলে আসছেন, কক্সবাজার থেকে ভাসান চরে স্থানান্তরের পর রোহিঙ্গারা তুলনামূলকভাবে উন্নত জীবনযাত্রা পাবে।

আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের সংক্ষিপ্তসারে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে বাঁশ ও তারপুলিন দিয়ে তৈরি ঘর প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকে। কিন্তু ভাসান চরে যে ক্লাস্টার নির্মাণ করা হয়েছে, তা অনেক বেশি সুরক্ষিত।

টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে ২০ জনের জন্য একটি টয়লেট এবং ৮০ জনের জন্য একটি গোসলখানা রয়েছে। অন্যদিকে ভাসান চরে ১১ জনের জন্য একটি টয়লেট এবং ১৬ জনের জন্য একটি গোসলখানা রয়েছে।

টেকনাফ ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় দিনে দিনে সেখানে পানির স্তর নিচে চলে যাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানির অভাব দেখা দিচ্ছে। ভাসান চরে প্রচুর সুপেয় পানির ব্যবস্থা থাকায় সে সমস্যা নেই।

কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা নেই। কিছু রাস্তায় সড়ক বাতি রয়েছে। কিন্তু সিংহভাগ অঞ্চল অন্ধকারে থাকে বলে রাতে অপরাধের ঘটনাও বেশি ঘটে। অন্যদিকে ভাসান চরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকছে।

টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে অনেক রোহিঙ্গার বসবাস এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব থাকায় সবার কাছে পৌঁছানোও কঠিন হয়। ভাসান চরে সে সমস্যা হবে না বলে প্রকল্প কর্মকর্তাদের ভাষ্য।

নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রকল্প এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে করা হয়েছে ভেড়ার খামার।

টেকনাফে রোহিঙ্গা বসতির কারণে জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, বাড়ছে বায়ুদূষণ, ভূমিক্ষয়, পানি দূষণ। প্রকৃতি ও প্রতিবেশের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। ভাসানচরে বসতির সঙ্গে ব্যাপক বনায়নের সুযোগ রয়েছে, ভূমিধস, বায়ুদূষণ কিংবা ভূমি ক্ষয়ের শঙ্কা নেই।

টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে রান্নার জন্য জ্বালানি কাঠ বা কয়লার ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু ভাসান চরে বায়োগ্যাস ও পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবস্থা রয়েছে।

কক্সবাজারে প্রায়ই মানব পাচারের শিকার হচ্ছে রোহিঙ্গারা, তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে মাদক চোরাচালানে। ভাসান চর সেসব দিক দিয়ে সুরক্ষিত।

ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও চিকিৎসার পাশাপাশি সীমিত আকারে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ দেওয়া হবে, যে ব্যবস্থা কক্সবাজারে সেভাবে নেই।

রোহিঙ্গারা এই দ্বীপে সরাসরি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে না পারলেও বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করতে পারবে।

দ্বীপ ঘুরে দেখা যায়, ভাসান চরে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে মহিষের খামার, কয়েক হাজার মহিষ সেখানে চড়ে বেড়াচ্ছে।

নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রকল্প এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে করা হয়েছে হাঁস, মুরগি, কবুতর, মাছ এবং ফল ও ফসলের খামার।

স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর জন্য দুগ্ধ খামার, ধান ও সবজি চাষ, হস্তশিল্প, নারীদের জন্য সেলাইয়ের কাজ এবং পর্যটনের প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে।

এসব প্রকল্পে মজুরির বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের কাজ দেয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানান।