ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, অধ্যাদেশ আসছে

একের পর এক যৌন নিপীড়নের ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের মধ্যে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করার প্রস্তাবে সায় দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Oct 2020, 07:34 AM
Updated : 12 Oct 2020, 12:15 PM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠকে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ সংশোধন করে অধ্যাদেশ আকারে জারির জন্য এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

পরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগামীকালই এ অ্যধ্যাদেশ জারি করা হবে।”         

২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি এতদিন ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। পাশাপাশি দুই ক্ষেত্রেই অর্থ দণ্ডের বিধান আছে।

ধর্ষণের অপরাধে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে বিচার ও রায় কার্যকর করার জন্য আইন সংশোধনের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই করা হচ্ছিল বিভিন্ন সংগঠনের তরফ থেকে।

রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে শনিবার বিকালে ’ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশে নিজের শাড়ীতে স্লোগান লিখে প্রতিবাদে অংশগ্রহণ। । ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সম্প্রতি নোয়াখালীতে বিবস্ত্র করে নির্যাতন, সিলেটের এমসি কলেজে তুলে নিয়ে ধর্ষণসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যৌন নিপীড়নের ঘটনার প্রেক্ষাপটে দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সেই দাবি আবারও জোরালো হয়ে ওঠে।

মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, গত কিছু দিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধগুলো কঠোরভাবে দমনের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) উপ-ধারায় বিধান সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়।

ওই উপ-ধারায় এতদিন বলা ছিল- যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্ধদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

“মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব এসেছে, নারী বা শিশু ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ, সমাজে নারী বা শিশু নির্যাতন কঠোরভাবে দমনের লক্ষ্যে আইনের ৯(১) উপ-ধারায় অধীন ধর্ষণের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড প্রদানের লক্ষ্যে আইন সংশোধন করা প্রয়োজন।”

সেই প্রস্তাবে মন্ত্রিসভা সম্মতি দেওয়ায় ৯(১) উপ-ধারায় ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

তিনি বলেন, “মন্ত্রিসভায় বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে সবাই একমত প্রকাশ করে প্রস্তাবটা গ্রহণ করেছেন। যেহেতু সংসদ কার্যকর নেই, সেজন্য এটা অধ্যাদেশের মাধ্যমে জারি করা হবে।”

এক প্রশ্নের জবাবে আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ধর্ষণের সংজ্ঞা পরিবর্তনের বিষয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি।

তবে বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ এর ১ (গ) ধারায় যৌতুকের জন্য সাধারণ জখম করার ঘটনা আপসযোগ্য ছিল না। সংশোধনে সেটা আপসযোগ্য করা হচ্ছে বলে তিনি।

বিচার প্রাপ্তি

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ধর্ষণের পর মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের।

আর এই আট মাসে ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৯২ জন নারী এবং ৯ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন।

তবে অনেক অভিযোগ থানা পর্যন্ত না পৌঁছানোয় প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে অধিকারকর্মীদের ধারণা।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে ধর্ষণের ঘটনায় ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার থেকে মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৫৪১টি। এর মধ্যে আসামির শাস্তি হয়েছে মাত্র ৬০টি ঘটনায়।

এ আইনের মামলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সাত দিন থেকে এক মাস এবং মামলা নিষ্পত্তির জন্য একশ আশি দিন (ছয় মাস) সময় বেঁধে দেওয়া থাকলেও বাস্তবে ওই সময়ের মধ্যে রায় দেওয়া সম্ভব হয় না।

তাছাড়া ধর্ষণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের এক একটি ঘটনা কিছু দিন পর পর সারা দেশকে নাড়া দিয়ে গেলেও এসব ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তির নজির কম।

ধর্ষণের বেশিরভাগ মামলা বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় ধামা চাপা পড়ে যায়। তাছাড়া ঠিকমত ডাক্তারি পরীক্ষা না হওয়া, সামাজিক জড়তা, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপসহ নানা কারণে বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।

এসব কারণে ধর্ষণের অপরাধে শাস্তির মাত্রা বাড়ানোর দাবি যেমন আছে, তেমনি শাস্তি বাড়ালেই এ ধরনের অপরাধ কমবে কি না, সেই প্রশ্নও আছে অনেকের মধ্যে।

তাদের ভাষ্য, সাক্ষ্য আইনের জটিলতা দূর করে বিচার পাওয়ার পথ সহজ করতে হবে। সেই সঙ্গে সামাজিকভাবে বিষয়টি মোকাবেলা করা জরুরি। 

আন্দোলনের কারণে এই আইন পরিবর্তন করা হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “শুধু আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, অনেকগুলো দেশের আইন চেক করে দেখেছে আমাদের আইন মন্ত্রণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

“আর বর্তমান পরিস্থিতি ও বাস্তবতা সবকিছু মিলেই এটা হয়েছে। শুধু আন্দোলনের জন্য তো জিনিসটা আসেনি। সরকারের মধ্য থেকেও এটার পক্ষে একটা প্রচার আসছে। মানুষের অ্যাওয়ারনেসের কারণে হয়ত এটা আসছে, সেটা হতে পারে।”

গেঞ্জিতে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী শ্লোগান, মুখে ব্যান্ডেজ পরে প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ, খালি গায়ে পিঠে ‘ধর্ষণ ও নির্যাতন বিরোধী বক্তব্য’ লিখে শুক্রবার শাহবাগে ধর্ষণবিরোধী সমাবেশে প্রতিবাদকারীরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

ধর্ষণের শাস্তি বাড়িনো হলে লাভ হবে কি না, সেই প্রশ্নে আনোয়ারুল বলেন, “যেভাবে প্রমোশন ক্যাম্পেইন হচ্ছে, এটাও তো একটা প্রমোশনের জায়গা। এটা অবশ্যই সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

“যারা ক্রাইম করে তারা অন্তত দুইবার চিন্তা করবে যে, এটাতে তো মৃত্যুদণ্ড আছে। এখন তো আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নয়। ১৮০ দিন তো দীর্ঘ সময়ও নয়। ডেফিনেটলি এটার পজিটিভ ইম্প্যাক্ট হবে।”

আনোয়ারুল বলেন, এই আইনে বলা হয়েছে আরোপিত অর্থদণ্ডকে, প্রয়োজনবোধে, ট্রাইব্যুনাল অপরাধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে গণ্য করতে পারবে এবং দণ্ডিত ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থদণ্ড বা ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় করা সম্ভব না হলে, ভবিষ্যতে তিনি যে সম্পদের মালিক বা অধিকারী হবেন সেই সম্পদ থেকে আদায়যোগ্য হবে এবং ওই সম্পদের ওপর অন্যান্য দাবির চেয়ে অর্থদণ্ড বা ক্ষতিপূরণের দাবি প্রাধান্য পাবে৷

“এটা যাতে আরেকটু প্রমিনেন্টলি আসে, ট্রায়ালে সেটা চিন্তা করা হবে।”

একই প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গুলশানে সাংবাদিকদের বলেন, “ধর্ষণের সাজা যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদণ্ড করায় এই অপরাধটি কমে আসবে, না হলে (শাস্তি) বাড়ানোর প্রশ্নে আসতাম না।”

তিনি বলেন, “আপনারা জানেন বিশ্বে মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে অনেক বিতর্ক আছে। তারপরেও আমাদের দেশে এই ঘৃণ্য অপরাধটির যে চিত্র দেখতে পাচ্ছি, সে কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন এটা বাড়ানো উচিত। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারটি সংশোধনীতে এনেছি।”

আইন কঠোর করার পাশাপাশি বিচারেও গতি আনার উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “আমি মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করব, তিনি যেন প্র্যাকটিস নির্দেশনা দেন যেন বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এইসব মামলাগুলির বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেন।

“অপরদিকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে আমরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে যে স্টেশন পিপিরা আছেন, তাদের নির্দেশনা দেব যে মামলাগুলো শেষ করার জন্য ইমিডিয়েট পদক্ষেপ নাও।”

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় আসা মামলাগুলোর পাশাপাশি সরকার পুরনো মামলাগুলোও নিষ্পত্তি করার ওপর জোর দেবে জানিয়ে আনিসুল হক বলেন, “ধর্ষণের পুরনো মামলাগুলো আগে করা হবে। নতুনগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করা হবে আইনি প্রক্রিয়ায়।

“আমর আইনে বিশ্বাস করি। আইনি প্রক্রিয়ায় যতটুকু সময় লাগে সেই সময়ের মধ্যে ধর্ষণ মামলাগুলোর বিচার যাতে সম্পন্ন করা যায়, সেই চেষ্টা সরকার করবে।... বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অবশ্যই রক্ষা করা হবে।”