করোনাভাইরাস: ৬ মাস থমকে যুদ্ধাপরাধের বিচার

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাড়ে তিন বছর আগে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ-কচুয়া এলাকার খান আশরাফ আলীসহ ১৪ আসামির বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগে আনে প্রসিকিউশন।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Oct 2020, 05:28 AM
Updated : 12 Oct 2020, 05:28 AM

এরপর বিভিন্ন বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। সর্বশেষ ১৯ মার্চ এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। এরপর ২৬ মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের কারণে অন্যান্য অফিসের পাশাপাশি আদালতেও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়।

পরে এই মামলার বিচারিক কাজের আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ইতোমধ্যে কয়েকটি তারিখ ঘুরে এই মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১৮ নভেম্বর সময় নির্ধারণ আছে।

মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ ছয় মাস ধরে ওই মামলাসহ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ৩৬টি মামলার অধিকাংশই তারিখ পরিবর্তন ছাড়া কোনো অগ্রগতি হয়নি। যদিও মধ্যে দুই আসামির জামিন বিষয়ে শুনানি এবং এক মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের সদস্যরা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে সাক্ষীদের ঢাকায় আনা এবং কারাগারে থাকা আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ওই সব মামলার কাজ এতদিন এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এছাড়া পাঁচ প্রসিকিউটর ও তাদের পরিবারের কোনো কোনো সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া এবং ট্রাইব্যুনালে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বেশ কয়েকজন সদস্য আক্রান্ত হওয়ার কারণে বিচার কাজ থমকে যায়।

তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে আরোপিত বিধি-নিষেধে শিথিলতার মধ্যে অফিস-আদালত চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসলে তখন থেকে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার কার্যালয় এবং প্রসিকিউশন কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত অফিস করছেন।

ইতোমধ্যে বিচারকরাও ট্রাইব্যুনালে শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়ে বিচার কাজ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে এই আদালতের রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের এজলাসে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিচারক, আসামি এবং সাক্ষীদের জন্য কাঁচ দিয়ে ঘিরে আলাদাভাবে অবকাঠামো করা হয়েছে।

শিগগিরই নিয়মিতভাবে ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৈশ্বিক করোনাভাইরাসের কারণে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো ট্রাইব্যুনালের কাজও বন্ধ ছিল। তবে যখনই প্রয়োজন পড়েছে ট্রাইব্যুনাল বসে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শুনানি করে আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু নিয়মিত বিচারিক কাজ চালানো সম্ভব হয়নি। আমরা আশা করছি, কিছু দিনের মধ্যেই বিচারপতিগণ এজলাসে বসে বিচার কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন, ট্রাইব্যুনাল থেকে সেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।”

আরেক প্রবীণ আইনজীবী প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শারীরিক উপস্থিতিতে বিচার কাজ চালানোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এজলাস কক্ষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মতো পরিবেশ করা হচ্ছে। বিচার কাজ শুরু হলে তখন হয়ত বুঝতে পারব মামলার কাজ কতটা এগিয়ে যাচ্ছে।”

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতি যে ‘খুব একটা ভালো না’, সেই বিষয়টি উল্লেখ করে সদ্য কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা রানা দাসগুপ্ত বলেন, “সামনে আমাদের দেশে শীত মৌসুম আসছে, তখন যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায় তাহলে তো সব ধরনের প্রস্তুতি নিলেও মামলা পরিচালনা করা কঠিন হয়ে যাবে। সেই সব বিষয়গুলোও ভাবতে হচ্ছে।”

গুরুত্বপূর্ণ স্তরে মামলা আটকে

চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর বিচার চলছে। ট্রাইব্যুনালের অপর ‍দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার।

গত ২২ মার্চ থেকে বিচারপতি আমির হোসেন অসুস্থাজনিত কারণে ছুটিতে আছেন। চেয়ারম্যান ও অপর সদস্য ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখছেন।

তবে ট্রাইব্যুনালের তিন সদস্যের বেঞ্চের সবাই না থাকায় আইনি কারণে মামলার রায় ঘোষণা, যুক্তিতর্ক গ্রহণ, অভিযোগ গঠন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ আমলে নিতে পারছে না বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ৩৬টি মামলার মধ্যে ময়মনসিংহের ভালুকা, পাগলা ও গফরগাঁও এলাকার মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত খলিলুর রহমান মীরসহ ১১ আসামির মামলাটি গত ২৬ জানুয়ারি থেকে রায়ের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।

এছাড়া আরও একটি মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন, আরেকটি অভিযোগ গঠন এবং অন্তত নয়টি মামলা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেওয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ স্তরে রয়েছে।

এছাড়া বাকি মামলাগুলো সাক্ষ্য গ্রহণসহ অন্যান্য পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন।

প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, “ট্রাইব্যুনালের একজন সদস্য ছুটিতে থাকলেও যেসব মামলা সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে আছে সেগুলোর সাক্ষ্যগ্রহণ করা যাবে। তবে করোনার কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগের মতো একসাথে বেশি সংখ্যক সাক্ষী হাজির করা সম্ভব হবে না। সেইজন্য দুই-একজন করে সাক্ষী এনে সাক্ষ্য নেওয়া হবে। এতে করে মামলা নিষ্পত্তি হতে কিছুটা সময় বেশি লাগবে।”

অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত বলেন, “মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেওয়া, মামলার অভিযোগ গঠন, যুক্তিতর্ক এবং রায় ঘোষণা- এসব বিষয়ের মাধ্যমে বিচারিক কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালের ফুল বেঞ্চ ছাড়া এখতিয়ার নেই। তবে অন্যান্য কাজ যেমন- সাক্ষ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের এক সদস্য বা দুই সদস্যও পারেন।”

তদন্ত চলছে, বিচারে যাচ্ছে না নতুন মামলা

এদিকে করোনাভাইরাসের কারণে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়মিত চলতে না পারলেও মানবতাবিরোধী অপরাধের নতুন অভিযোগের তদন্ত কাজ অব্যাহত রেখেছে তদন্ত সংস্থা।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও তদন্ত কাজ অব্যাহত রেখেছি। এই অবস্থার মধ্যেও দুটি তদন্ত প্রতিবেদন এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র প্রসিকিউশনে আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দিয়েছি। কিছু দিনের মধ্যে আরও দুই থেকে তিনটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।”

এক বিচারক অসুস্থতাজনিত কারণে ছুটিতে থাকায় ট্রাইব্যুনালের বিচারিক পর্যায়ের প্রথম স্তর মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেওয়া বা অভিযোগ গঠনের ক্ষেত্রে এখতিয়ার না থাকার কথা বলেন সানাউল হকও।

তিনি বলেন, “এই জায়গায় এসে তো সমস্যা হবেই। উনি (বিচারক) যদি দ্রুত সুস্থ হয়ে যোগদান করেন তাহলে তো এই সমস্যার সমাধান হবে। তবে উনার অসুস্থতা বা ফিরতে যদি দেরি হয় সেই কারণে বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে তখন সরকার নিশ্চয় তা বিবেচনা করবে।”

ট্রাইব্যুনালের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শিগগিরই নিয়মিতভাবে শুরু হবে। সেই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আশা করছি নতুন মামলা আসবে, যেসব মামলা বিচারাধীন আছে সেগুলো বিচারের মধ্যে দিয়ে নিষ্পত্তি হবে।”

ট্রাইব্যুনালের এক বিচারক অসুস্থতাজনিত কারণে ছুটিতে থাকায় বিচারের বিশেষ ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়ার যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে সেই বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “উনি অসুস্থ, যে কারণে ছুটিতে আছেন। এর ফলে মামলার বিচার চলতে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে সেই বিষয়টি আমরা দেখব কী করা যায়।”

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার গত ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে ছুটি ঘোষণা করে। তখন দেশের সব আদালতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টও। সরকারের সাধারণ ছুটির সাথে আদালতের সাধারণ ছুটিও কয়েক দফা বাড়ানো হয়।

সর্বশেষ গত ৩০ মে পর্যন্ত আদালতের সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। তবে এই পরিস্থিতিতে ‘ভার্চুয়াল আদালতে’ শুনানির জন্য গত ৯ মে সরকার ‘আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার’ অধ্যাদেশ জারি করে, সংসদ যেটিকে পরে আইনে পরিণত করেছে।

এরপর সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগ পরিচালনার জন্য ১৩ দফা, হাই কোর্ট পরিচালনার জন্য ১৫ দফা ও অধস্তন আদালত পরিচালনার জন্য ২১ দফা প্র্যাকটিস নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এই নির্দেশনা আলোকেই ১১ মে থেকে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের অধস্তন ও ১২ মে থেকে উচ্চ আদালতে বিচারকাজ চলছে।