উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তির স্বস্তি

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে পরীক্ষা না নিয়ে অষ্টমের সমাপনী এবং এসএসসির ফলের ভিত্তিতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Oct 2020, 02:11 PM
Updated : 7 Oct 2020, 02:16 PM

পরীক্ষা হলে আরও ভালো ফল হত বলে কোনো কোনো পরীক্ষার্থী আশা করলেও মাথা থেকে দীর্ঘদিনের ‘বোঝা’ নেমে যাওয়ার হাঁফ ফেলছেন তারা।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, দুটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে একাদশ ও দ্বাদশের শ্রেণি মূল্যায়নকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে এই মূল্যায়নটা আরও ভালো হত।

গত ১ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর কথা থাকলেও করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে তা আটকে যায়।

এরপর প্রাথমিক সমাপনী, জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত হলেও এইচএসসি ঝুলেই থাকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও বলছিলেন, পরিস্থিতি ভালো হলেই পরীক্ষাটি নিয়ে নেবেন তারা।

কিন্তু তা কবে হবে, তেমন কোনো ধারণা না পেয়ে উৎকণ্ঠায় ছিলেন প্রায় ১৪ লাখ পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা।

সেই উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বুধবার জানান, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা এবার হবে না, অষ্টমের সমাপনী ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে।

ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সংগঠন ‘অভিভাবক ঐক্য ফোরাম’ এর সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু এই সিদ্ধান্তের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চাই শুধু পরীক্ষা নয়, করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি’ও নেওয়া যাবে না।”

মহামারীর মধ্যে পরীক্ষা নেওয়ার সময় কোনো শিক্ষার্থীর ক্ষতি হলে তার দায় সরকারের ওপর পড়ত বলে মনে করেন তিনি।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম এইচএসসি পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখন যে পরিবেশ, যে পরিস্থিতি এতগুলো বাচ্চাকে পরীক্ষার হলে আনার মতো পরিস্থিতি কবে আসত, তা কিন্তু কেউ বলতে পারবে না।

“সরকার তো অনেক দিন অপেক্ষা করল। ছেলেমেয়েরাও কবে পরীক্ষা হবে সেই চিন্তায় মানসিক হতাশার মধ্যে ছিল।”

জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে এইচএসসির মূল্যায়ন করা হলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না- সে প্রশ্নে শাহান আরা বলেন, “পরীক্ষা হলে হয়ত কারও কারও ফলাফল একটু এদিক-সেদিক হত, এখন উনিশ-বিশ হবে, মেনে নিতে হবে, কিছু করার নেই।”

সরকার অনেক চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করেন অধ্যক্ষ শাহান আরা।

তিনি বলেন, “একদিকে করোনা, অন্যদিকে ছিল বন্যা। শিক্ষার্থীসহ সবার নিজের সুরক্ষার বিষয়কেই এখন সব থেকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত।”

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এবার এমন করে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ ছিল না বলে বিশেষজ্ঞরা মত জানিয়েছিলেন। (ফাইল ছবি)

অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. রেজাউজ্জামান ভুইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই পরিস্থিতিতে শতভাগ পারফেক্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই।

“কেউ কিছুটা বেনিফিটেড হবে কেউ কম, এটাই স্বাভাবিক, এটা সবাইকে মানতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে এটাই হবে। অনেকে হয়ত পরীক্ষা দিয়ে আরও ভালো করতে পারব, তারা সেই সুযোগ হারলো।”

রেজাউজ্জামান বলেন, “সরকার ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষার্থীরা সাত মাস অপেক্ষা করে আছে, তারা মেন্টাল প্রেসারে ছিল, তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকরাও এক ধরনের মানসিক চাপে ছিলেন।”

শিক্ষক ও অভিভাবকদের বেশিরভাগই সরকারের এই পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও তাতে একমত হতে পারছেন না উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ উম্মে সালেমা বেগম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয় কমিয়ে বেসিক বিষয়গুলোর পরীক্ষা নেওয়া যেত। সেক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়ে পরীক্ষা নিতে হত। সবাই তো বাইরে যাচ্ছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব কিছুই তো খোলা।”

পরীক্ষা না নেওয়ার এই সিদ্ধান্তে যারা ভালোমত পড়াশোনা করেছে তারা হতাশায় ভুগবে বলে মনে করেন এই শিক্ষক।

পরীক্ষা হোক আর নাই হোক, সেই সিদ্ধান্তটা ঘোষণা করে উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীদের উৎকণ্ঠার অবসান করা জরুরি ছিল বলে মনে করেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরে উৎকণ্ঠার অবসান হল। সরকারের এই ঘোষণাকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখছি, এই ঘোষণাটা জরুরি ছিল।”

তবে অষ্টমের সমাপনী এবং এসএসসির ফলের সঙ্গে একাদশ ও দ্বাদশের শ্রেণি মূল্যায়ন যোগ করা হলে মূল্যায়নটা আরও ভালো হত বলে মত দেন ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, “আমাদের তো পরীক্ষার ফলাফলের তেমন দাম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা যাতে সুষ্ঠু হয় এখন সেটা নিশ্চিত করতে হবে।”

মহামারীকালে টিউশন ফি কমানোর দাবিতে ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতেও সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে হয়েছিল সংক্রমণ এড়াতে (ফাইল ছবি)

মুক্তির আনন্দ

এইচএসসি পরীক্ষা হলে ফল আরও ভালো বা খারাপ হত কি না, এখন আর সেসব নিয়ে চিন্তা করতে চাইছেন না এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা।

তারা বলছেন, গত ছয় মাস ধরে যে ‘বোঝা’ মাথায় নিয়ে ছিলেন তার অবসান হওয়ায় এখন মানসিকভাবে চিন্তামুক্ত হতে পেরেছেন।

ঢাকার একটি কলেজের শিক্ষার্থী শারমিন বিথী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরীক্ষা নিয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেয়েছি এর থেকে আনন্দের কিছু নেই। ছয় মাসেরও বেশি সময় নিয়ে আমরা অপেক্ষায় ছিলাম।”

আমিরুল ইসলাম নামের আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, “রেজাল্ট কী হত সেটা পরের কথা। আমরা চিন্তামুক্ত হলাম, এটাই আনন্দের। মনে হচ্ছে আজ আমি মুক্তি পেলাম।”

তবে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ঘরবন্দি থেকে এইচএসসি পরীক্ষার জন্য ভালো প্রস্তুতি নিয়েও এই পরীক্ষায় বসতে না পারায় আপেক্ষ থেকে যাচ্ছে কিছু শিক্ষার্থীর।

সৌমিক নামের একজন শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাইনি বলে এইচএসসির জন্য ভালো করে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, কিন্তু এখন কিছুই করার নেই।

“এইচএসসিতে জিপিএ আমার কম আসবে। আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার স্কোরিংয়ে আগেই পিছিয়ে গেলাম। আর কোনো কারণে যদি এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা না হয়, তাহলে এটা আমার জন্য খুব খারাপ খবর হবে।”