দুদকের ভাষ্য: রিজেন্ট ‘যেভাবে’ কোভিড হাসপাতাল হয়েছিল

জালিয়াতি-প্রতারণায় আলোচিত মোহাম্মদ সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল কীভাবে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য নিবেদিত হাসপাতাল হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল, তার একটি ভাষ্য এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা এক মামলায়।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Sept 2020, 04:57 PM
Updated : 23 Sept 2020, 05:17 PM

দুদক বলছে, রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের লিখিত কোনো নির্দেশনা ছিল না। একজন পরিচালকের ‘মনগড়া’ পরিদর্শন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এক দিনের মধ্যে চার টেবিল ঘুরে বিষয়টি অনুমোদন পেয়ে যায় এবং তার দুই দিনের মাথায় রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদের সঙ্গে চুক্তি করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তখনকার মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ।

দুদকের উপ-পরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী বুধবার কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ এই মামলা দায়ের করেন। রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চার কর্মকর্তাকে সেখানে আসামি করা হয়েছে।

সাহেদ ছাড়া বাকি আসামিরা হলেন- স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাবেক পরিচালক আমিনুল হাসান, উপ-পরিচালক (হাসপাতাল-১) ডা. মো. ইউনুস আলী, সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল-১) ডা. মো. শফিউর রহমান এবং গবেষণা কর্মকর্তা ডা. মো. দিদারুল ইসলাম।

এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা ‘অসৎ উদ্দেশ্যে অন্যায়ভাবে লাভবান হওয়ার অভিপ্রায়ে পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে’ লাইসেন্সের মেয়াদবিহীন বন্ধ রিজেন্ট হাসপাতালকে ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে রূপান্তর, মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং সম্পাদন ও সরকারি প্রতিষ্ঠান নিপসমের ল্যাবে তিন হাজার ৯৩৯ জন কোভিড রোগীর নমুনা বিনামূল্যে পরীক্ষা করিয়েছেন।

“যেখান থেকে অবৈধ পারিতোষিক বাবদ রোগী প্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা হিসেবে এক কোটি ৩৭ লাখ ৮৬ হাজার ৫০০ টাকা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর ও উত্তরা শাখার চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয় ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের খাবার খরচ বরাদ্দের বিষয়ে এক কোটি ৯৬ লাখ ২০ হাজার টাকার মাসিক চাহিদা তুলে ধরেছেন।”

রিজেন্টের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুক্তির সই হয়েছিল গত ২১ মার্চ, সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন

রিজেন্ট হাসপাতলের সঙ্গে চুক্তি সংক্রান্ত নোটে একমত পোষণ এবং অনুমোদন দিয়ে স্বাক্ষর করলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আজাদ কিংবা অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানাকে এজাহারে আসামি করা হয়নি।

এজাহারে বলা হয়, ২০১৭ সালের ৩০ জুন রিজেন্ট হাসপাতালের নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর হাসপাতলের নিবন্ধন আর নবায়ন হয়নি।

এ অবস্থায় গত ১৯ মার্চ রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখাকে কোভিড ডেডিকেটের হাসপাতাল হিসেবে বিবেচনার জন্য জরুরিভাবে পরিদর্শন করে অধিদপ্তরে প্রতিবেদন দেন অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. আমিনুল হাসান।

ওই প্রতিবেদনে হাসপাতালের দুটির শাখা ‘স্বেচ্ছায় বিনামূল্যে কোভিড রোগীদের সেবা দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে’ উল্লেখ করে বিষয়টি বিবেচনা করার সুপারিশ করা হয়।

এরপর একই দিন ১৯ মার্চ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শফিউর রহমান কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন দিয়ে কোভিড হাসপাতাল হিসেবে চালু করার জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের (এমওইউ) প্রস্তাব করে নথিটি উপ-পরিচালক ইউনুস আলীর কাছে উপস্থাপন করেন।

ইউনুস আলী ওই নোটে একমত পোষণ করে একই দিন ১৯ মার্চ নথিটি পরিচালক আমিনুল হাসানের কাছে উপস্থাপন করেন। আমিনুল নোটের সাথে একমত পোষণ করে একই দিন নথিটি অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানার কাছে উপস্থাপন করেন।

ডা. নাসিমা সুলতানাও নোটের সাথে একমত পোষণ করে একই দিন নথিটি মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের কাছে উপস্থাপন করেন। এরপর ডা. আজাদ ওই প্রস্তাব অনুমোদন করেন।

তার দুই দিন পর ২১ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষে মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ এবং হাসপতালের পক্ষে মোহাম্মদ সাহেদের মধ্যে এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির মেয়াদ উল্লেখ করা হয় মার্চ থেকে সেপ্টম্বর পর্যন্ত।

এজাহারে বলা হয়, এই এমওইউ স্বাক্ষর করার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ‘লিখিত কোনো নির্দেশনা ছিল না’।

“ডা. আমিনুল হাসান ১৯ মার্চ মনগড়া পরিদর্শন প্রতিবেদন এবং আসামি সহকারী পরিচালক শফিউর রহমান, উপ-পরিচালক ইউনুস আলী, পরিচালক আমিনুল হাসানের উপস্থাপিত পক্ষপাতমূলক নোটের কারণে এমওইউ সম্পাদনের কার্যক্রম গতি পায়।”

আর ওই চুক্তি করার জন্য ‘অন্যায় কার্যক্রম গ্রহণ করে’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ‘বেআইনিভাবে লাভবান’ হয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে মামলায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কক্ষে আলাপচারিতার এই ছবি গত ৮ এপ্রিল ফেইসবুকে পোস্ট করেছেন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ।

আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে এ মামলার এজাহারে।

করোনাভাইরাসের পরীক্ষা না করে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া, সরকারের কাছে বিল দেওয়ার পর আবার রোগীর কাছ থেকেও অর্থ নেওয়াসহ নানা অনিয়মের খবর পেয়ে র‌্যাব গত ৭ ও ৮ জুলাই অভিযান চালিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর ও উত্তরা শাখা বন্ধ করে দেয়। পরে ওই হাসপাতালের অনুমোদন বাতিল করে স্বাস্থ্য বিভাগ।

তখনই জানা যায়, লাইসেন্সের মেয়াদ নেই জেনেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত মার্চে রিজেন্ট হাসপাতালকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য ‘ডেডিকেটেড’ ঘোষণা করে সমঝোতা স্মারকে সই করেছিল। 

অথচ ২১ মার্চ রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তৎকালীন সচিব আসাদুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।

বিতর্কিত রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি করা নিয়ে সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ১১ জুলাই দাবি করে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’ নির্দেশে ওই চুক্তি করা হয়েছিল। পরে অধিদপ্তরের ওই বক্তব্যের ব্যাখ্যা চায় মন্ত্রণালয়।

জবাবে আরেক চিঠিতে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আজাদ দাবি করেন, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সাবেক সচিব আসাদুল ইসলামের ‘নির্দেশে’ রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল।

চুক্তি স্বাক্ষরের আগে প্রস্তাব তৈরি ও অনুমোদন প্রক্রিয়ায় অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আজাদ কিংবা অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা যুক্ত থাকলেও তাদের আসামি না করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দুদক সচিব দিলোয়ার বখত বলেন, "অনুসন্ধান কর্মকর্তা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সরাসরি প্রমাণ পেয়েছেন তাদেরকে আসামি করা হয়েছে। তবে এখানেই শেষ নয়, মামলা তদন্তে যদি আরও কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় তাদেরকে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।"

২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদে ছিলেন ডা. আজাদ। সরকারি চাকরির বয়স শেষ হওয়ার পরও তাকে চুক্তিতে নিয়োগ দিয়ে ওই পদে রেখেছিল সরকার।

কিন্তু গত মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একের পর এক কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ হতে থাকলে বিপাকে পড়তে হয় ডা. আজাদকে। মাস্ক কেলেঙ্কারির পর করোনাভাইরাসের পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিয়ে জেকেজি হেলথ কেয়ার ও রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণ ও জালিয়াতির খবর ফাঁস হলে তিনি তোপের মুখে পড়েন। এরপর গত ২১ জুলাই তিনি পদত্যাগপত্র দেন।

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ১২ ও ১৩ অগাস্ট ডা. আজাদকে দুদকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছিল।

সে সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “কেউ অপরাধ করলে তার কঠোর শাস্তি হোক এটা আমি চাই, এ বিষয়ে তদন্তে আমি প্রয়োজনীয় সকল সহযোগিতা প্রদান করব।”