সীমান্ত সম্মেলনে হত্যা বন্ধে ফের আশ্বাস বাণী

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে রক্তক্ষয় বাড়ার মধ্যে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সম্মেলনে এই হত্যা বন্ধে আগের আশ্বাসই ঘুরেফিরে এল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Sept 2020, 07:35 AM
Updated : 19 Sept 2020, 10:41 AM

সীমান্ত সম্মেলন শেষে শনিবার যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসে ভারতের বিএসএফের প্রধান রাকেশ আস্থানা ‘কার্যকর ব্যবস্থা’ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

হত্যা বন্ধে সীমান্তে অপরাধ দমনে যৌথভাবে কাজ করার ‍উপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম।

সম্মেলনের শেষ দিন শনিবার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এর মধ্যে মহাপরিচালদের যৌথ দলিল সই হয়।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহতের ঘটনা বরাবরই আলোচনায় থাকে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মধ্যে ভারত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর সীমান্তে হত্যাকাণ্ড কয়েক বছর আগে কমে এলেও সম্প্রতি তা আবার বাড়ছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সাড়ে আট মাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তে সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৩৯ বাংলাদেশির। এর মধ্যে ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে বিএসএফ সদস্যদের গুলিতে। পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে বিএসএফ সদস্যদের শারীরিক নির্যাতনের পর।

গত বছর এই সময় (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) সীমান্তে বিএসএফের গুলি বা নির্যাতনে মারা গিয়েছিলেন ২৮ জন বাংলাদেশি।

গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে সীমান্ত হত্যা কিছুটা কমলেও সেটি তিন গুণ বাড়ে ২০১৯ সালে।

সংস্থাটির আরেক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সীমান্তে ১৫৮ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে।

প্রতিবারের মতো এবারও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সম্মেলনে সীমান্তে হত্যার বিষয়টি আলোচনায় আসে।

ঢাকার পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে বিএসএফ প্রধান রাকেশ আস্থানা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “শেষ উপায় হিসেবে গুলি চালানোর বিষয়ে বিএসএফ সদস্যরা সবসময় নির্দেশনা পেয়ে থাকে। একইসঙ্গে নন-লেথাল অস্ত্র ব্যবহার করার জন্যও নির্দেশনা রয়েছে।

“দুই দেশের সীমান্তে মাদক, পশু চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর ঘটনা অতীতে ঘটেছে। আমরা দুই বাহিনী সীমান্তে সংগঠিত অপরাধ বিষয়ে ‘রিয়েল টাইম ইনফরমেশন’ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে একমত হয়েছি। যারা এসব অপরাধের পিছনে কাজ করছে তাদের বিষয়েও তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়ে আমরা একমত করেছি।”

সীমান্ত হত্যা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিএসএফ প্রধান বলেন, “সীমান্তে যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলো বেশিরভাগই রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টার ভেতর। অপরাধীরা এই সময়ে তাদের কাজ চালায়। এসব অপরাধ দমন করতে গিয়ে এবছর ৫২ জন বিএসএফ সদস্য আহত হয়েছেন।

“অপরাধীরা সংঘবদ্ধ হয়ে টহল দলের উপর হামলা করলে মারণাস্ত্র প্রয়োগ করা হয়। আমি কোনো হত্যার বৈধতা দিচ্ছি না। তারপরেও আমাদের সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া আছে, যদি গুলি চালাতেই হয় তবে যেন শরীরের নিচের অংশে চালানো হয়। তবুও রাতে ভিজিবিলিটি কম থাকায় অনেকসময় দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। তারপরেও ভবিষ্যতে আপনারা দেখতে পারবেন আমরা এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেব।”

বিজিবি প্রধান সাফিনুল ইসলাম বলেন, “সীমান্ত হত্যা বন্ধে বিএসএফের পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে।”

রাকেশ আস্থানা বলেন, “আমাদের নীতি হচ্ছে, সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা। আমরা এটা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই সম্মেলনে আমরা বিজিবিকে আশ্বস্ত করেছি যৌথ সমন্বিত টহলের মাধ্যমে এই কাজটি আমরা করব।”

 

বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া এই সম্মেলনে ১৩ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাফিনুল। এই দলে ছিলেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও বিজিবি সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট স্টাফ অফিসার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যৌথ নদী কমিশন এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে ছয় সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বিএসএফ মহাপরিচালক রাকেশ আস্থানা। তার দলে ছিলেন বিএসএফ সদর দপ্তর এবং ভারতের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

সংবাদ সম্মেলনে বলা জানানো হয়, সীমান্তে মৃত্যুর বিষয়ে বিজিবির উদ্বেগের প্রতিক্রিয়ায় বিএসএফ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহারের নীতি পুনর্ব্যক্ত করে এবং সব নিরস্ত্র, নিরপরাধ এবং মানবপাচারের শিকার ব্যক্তিকে বিজিবি সদস্যদের নিকট হস্তান্তরের আশ্বাস দেয়।

বিএসএফ মহাপরিচালক সব ধরনের চোরাচালান বন্ধে গবাদি পশু চোরাচালান প্রবণ অঞ্চলে যৌথ টহল শুরু করার প্রস্তাব করেন।

বিজিবি এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে এবং উভয় বাহিনী একমত হয়েছে যে, সীমান্তে চোরাচালান সিন্ডিকেটগুলি যে নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করছে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে চোরাচালান প্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করতে হবে।

সম্মেলনে মানব পাচার ও অবৈধভাবে আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে।

উভয় মহাপরিচালক নিজ নিজ দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী মানবপাচারে ক্ষতিগ্রস্থদের যত দ্রুত সম্ভব উদ্ধার ও পুনর্বাসনের সুবিধার্থে সহায়তা করতে সম্মত হয়েছে।

সম্মেলনে সাম্প্রতিক সময়ে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ/জোরপূর্বক পুশ-ইন নিয়ে উদ্বোগ প্রকাশ করে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিদের জাতীয়তা যাচাই করতে এবং একে অপরের সহযোগিতায় তাদের হস্তান্তর ত্বরান্বিত করতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে।

দু’দেশেই পূর্ব অনুমোদন ছাড়া ১৫০ গজের মধ্যে কোন ধরণের উন্নয়নমূলক কাজ না করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে।   

যৌথ নদী কমিশনের অনুমোদন অনুযায়ী সীমান্ত নদীর তীর সংরক্ষণে সহায়তা প্রদান এবং অননুমোদিত অভিন্ন নদীর তীর সংরক্ষণে কাজ না করতে সম্মত হয়েছে।

বিজিবি সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে বসবাসরতদের জন্য দৈনিক ভ্রমণ পাস দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, যাতে তারা ভারতে তাদের আত্মীয়দের দেখতে যেতে পারে।

বিএসএফ এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে এবং উভয় বাহিনী এ জাতীয় সামাজিক ভ্রমণ সহজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা/ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি প্রক্রিয়া তৈরির বিষয়ে সম্মত হয়েছে।

আগামী নভেম্বর মাসে ৫১তম সীমান্ত সম্মেলন ভারতের আসামের গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়।