উদ্বেগে পাটকল শ্রমিকরা, কথা বলতে নারাজ মন্ত্রণালয়

‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের’ টাকা কবে পাবেন, তা নিয়ে উদ্বেগে আছেন বন্ধ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পাটকলগুলোর শ্রমিকরা।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Sept 2020, 05:09 PM
Updated : 5 Sept 2020, 08:18 PM

সরকারের পক্ষ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই এই অর্থ পরিশোধের ঘোষণা দেওয়া হলেও এখনও তার প্রস্তুতির কিছু দৃশ্যমাণ না হওয়ায় এই উদ্বেগ তাদের। প্রভিডেন্ট ফান্ড (এফ), গ্রাচুইটি, মঞ্জুরি কমিশনের বকেয়া, মৃত্যু বীমার দাবিসহ খাতওয়ারি ন্যায্য পাওনা মিলবে কি না সে প্রশ্নেরও জবাব খুঁজছেন তারা। 

এদিকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করলেও বিস্তারিত তথ্য জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সচিব লোকমান হোসেন মিয়া।

ধারাবাহিকভাবে লোকসানে থাকা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলের ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারীর চাকরি ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের’ মাধ্যমে অবসায়নের সিদ্ধান্ত দুই মাস আগে জানিয়েছিলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।

সে সময় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, শ্রম আইন অনুযায়ী নোটিশ মেয়াদের অর্থাৎ ৬০ দিনের মজুরি। চাকরিবিধি অনুযায়ী প্রাপ্য গ্রাচ্যুইটি, পিএফ তহবিলে জমাকৃত অর্থ এবং নির্ধারিত হারে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক সুবিধা পাবেন শ্রমিকরা। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, প্রতি শ্রমিক সর্বনিম্ন ১৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫৪ লাখ টাকা পর্যন্ত পাবেন।

একই সাথে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত অবসরে যাওয়া ৮ হাজার ৯৫৬ জন শ্রমিক ও বদলি শ্রমিকদের সমুদয় পাওনাও এই সঙ্গে পরিশোধের ঘোষণা দেওয়া হয়।

শ্রমিকের পাওনার অর্ধেক নগদ এবং বাকি অর্ধেক তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র আকারে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। তবে শ্রমিকদের অনেকে তাদের পাওনা টাকা এককালীন চাইছেন।

‘পে স্লিপ কবে পাব, জানি না’

উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পাটকলগুলোর বেশ কয়েকটিতে অগাস্টের শেষ সপ্তাহে বকেয়া, পাওনার তালিকা টাঙানো হলেও তাতে অসঙ্গতির অভিযোগ তোলেন শ্রমিকরা। পরে ওই সব তালিকা তুলে নেওয়া হয়।

খুলনার পাটকল আন্দোলনে গঠিত নাগরিক পরিষদ সদস্য ইয়াসির রশীদ জানান, কিছু দিন আগে খুলনার ইস্টার্ন জুট মিল গেটে শ্রমিকদের প্রাপ্য তালিকা টাঙিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাতে ‘অসঙ্গতি’ দেখে শ্রমিকরা একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ শুরু করলে ওই তালিকা সরিয়ে ফেলে মিল কর্তৃপক্ষ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পিএফ আর গ্রাচুইটি বিল বাবদ শ্রমিকদের যে পাওনা আসে, তার সঙ্গে সে তালিকায় দেখানো অর্থের কোনো মিল ছিল না। এ নিয়ে আমরা বিজেএমসির কাছে বারবার ধরণা দিয়েছি। কিন্তু তারা আমাদের সুস্পষ্টভাবে কিছু বলছে না। দুই তিন রকমের বিল করছে তারা।”

বাংলাদেশ শ্রমিক লীগের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, “গত ৩০ জুন তারিখে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ২৫টি পাটকল আধুনিকায়ন করে পুনরায় চালু করার প্রত্যয়ে শ্রমিকদের চাকরি অবসায়ন করে তাদের খাতওয়ারি শতভাগ ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন।

“কিন্তু পিএফ, গ্রাচুইটি, মঞ্জুরি কমিশনের বকেয়া, মৃত্যু বীমার দাবিসহ খাতওয়ারি শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনার হিসাব এখনও চূড়ান্ত হয়নি। পে স্লিপ কখন কীভাবে প্রদান করা হবে, তা এখনও অজানা রয়েছে। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।”

‘সংবাদ সম্মেলনের আগে কোনো তথ্য নয়’

পাটকল শ্রমিকদের বকেয়াদি পরিশোধের বিষয়ে অগ্রগতি কতটা হল জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের পাট অনুবিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব আবু বকর সিদ্দিক বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অগ্রগতির বিষয়ে তথ্য আছে। কিন্তু আমি বলতে পারব না। সচিবের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি না বললে, মন্ত্রণালয়ের পিআর আছে, তার সাথে কথা বলেন। আমি তথ্য দেব না।”

পাটকল বন্ধের ঘোষণার প্রতিবাদে খুলনায় সন্তানদের নিয়ে কর্মসূচি পালন করেন শ্রমিকরা।

পরে বস্ত্র ও পাট সচিব লোকমান হোসেন মিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো সংবাদমাধ্যমকে বিচ্ছিন্নভাবে এটা নিয়ে বলার সুযোগ নেই। আমরা কাজ করছি। আপনাদের (সাংবাদিকদের) দাওয়াত দেব। তখন এটা নিয়ে বিস্তারিত বলব।”

আর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈকত চন্দ্র হালদার বলেন, “যত দূর জানি, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড় হলেই শ্রমিকদের মজুরি, বকেয়া পরিশোধ করা হবে। সেটা কবে তা জানি না।”

অভিযোগ অনেক

চাকরি খোয়ানোর পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন সরকার দলীয় শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও।

বাংলাদেশ শ্রমিক লীগের সভাপতি সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বিজেএমসি পরিচালিত মিলগুলোর মধ্যে যেসব মিল ঋণ নিয়েছে তারা যথাসময়ে তা পরিশোধ না করায় প্রভিডেন্ট ফান্ড (পিএফ) শুন্য অবস্থায় পড়ে আছে।

উদাহরণ দিয়ে চট্টগ্রামের হাফিজ জুট মিলের এই শ্রমিক নেতা বলেন, “হাফিজ জুট মিল কর্তৃপক্ষের পিএফ থেকে প্রায় ৩৪ কোটি টাকার দেনা রয়েছে, যার লভ্যাংশ দেখানো হয়েছে ১ শতাংশ। পরিতাপের বিষয় হল জনতা ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের সুদ ১৩ শতাংশ প্রদান করলেও পিএফ ফান্ড থেকে মিল কর্তৃপক্ষ গৃহীত ঋণের বিপরীতে ১.৫ থেকে ২ শতাংশ সুদ প্রদান করে আসছে।”

মাহবুবুল আলম বলেন, “গত ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে অদ্যবধি পিএফ চূড়ান্ত বিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় যে, ১ থেকে ২ শতাংশ লভ্যাংশ প্রদান করে আসছে চূড়ান্ত বিলে। এর ফলে পিএফ সদস্যরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।”

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ২ (১০) এ গ্রাচুইটির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, গ্রাচুইটির অর্থ কোনো শ্রমিকের প্রতি পূর্ণ বছর চাকরি অথবা ছয় মাসের অতিরিক্ত সময়ের চাকরির জন্য তার সর্বশেষ প্রাপ্ত মজুরি হারে ন্যূনতম ৩০ দিনের অথবা ১০ বছরের চাকরির ক্ষেত্রে তার সর্বশেষ প্রাপ্ত মজুরি হারে ৪৫ দিনের মজুরি যা উক্ত শ্রমিককে তার চাকরির শেষে অবসানে প্রদেয়, ইহা এই আইনের অধীনে শ্রমিকের বিভিন্নভাবে চাকরির অবসানজনিত কারণে মালিক কর্তৃক প্রদেয় ক্ষতিপূরণ বা নোটিসের পরিবর্তে প্রদেয় মজুরি বা ভাতার অতিরিক্ত হবে।

মাহবুবুল আলমের অভিযোগ, এখন কারখানায় হাজিরার ভিত্তিতে গ্রাচুইটি নির্ধারণ করতে চাইছে বিজেএমসি।

তিনি বলেন, “ওনারা এখন বলছেন যে, বছরে ১২০ দিন হাজিরা না থাকলে তাকে গ্রাচুইটি দেওয়া যাবে না। কিন্তু আমাদের হাজিরার ভিত্তিতে তো হচ্ছে বোনাস। বোনাসের হিসাব হল, একজন শ্রমিক যদি বছরে ৮০ দিন চাকরি করে তাহলে সে এক মাসের মূল মজুরির অর্ধেক পাবে। আর একজন শ্রমিক যদি ১৬০ দিন চাকরি করে তাহলে সে এক মাসের মূল মজুরি পাবে। সে বোনাস আমাদের দেয় নাই গত ঈদে।”

মাহবুবুল আলমের অভিযোগ, শ্রম আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শ্রমিকদের মূল বেতন থেকে বাসা ভাড়া বাবদ ‘১০ শতাংশ’ কেটে নিচ্ছে পাটকল কর্তৃপক্ষ।

তিনি বলেন, “মজুরি কাঠামো অনুসরণ না করে মনগড়া নীতি নির্ধারণ করেছে পাটকল কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি কাঁচা ঘরের উপর কর্তৃপক্ষ কখনো কখনো টিনের ছাউনি দিয়েছে। তাতেই ১০ শতাংশ কেটে নিচ্ছে মূল মজুরি থেকে। এটা শ্রমিকদের প্রতি অন্যায়।”

২০১৫ সালের শ্রম আইনে শ্রমিকদের মজুরি, কর্মঘণ্টা, বিশ্রাম, অধিকাল ভাতা, ছুটি বিষয়ে আইনের বিধানাবলী অনুসরণ করতে বলা হলেও তার কোনোটাই মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন সিরাজগঞ্জের পাটকল বদলি শ্রমিক সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “আইন অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকের দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার থাকলেও প্রায় তাকে দিয়ে বেশি সময় কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। শ্রম আইন অনুযায়ী তাদের দ্বিগুণ মজুরি প্রদান করা হয়নি। ২০১৫ সালের নীতিমালা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণমূলক ছুটি দেওয়ার কথা থাকলেও তাও তাদের দেওয়া হচ্ছে না।”

শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, পিকস রেট প্রদানেও অনিয়ম হচ্ছে।

২০১৫ সালের শ্রম নীতিতে পিকস রেটের বিষয়ে বলা আছে, আংশিক কাজের ক্ষেত্রে শ্রমিককে তাহার প্রাপ্য নির্ধারিত গ্রেডে ন্যূনতম মজুরিতে ঘাটতি থাকলে মালিক তা পূরণ করে দেবেন। কাজের স্বল্পতার কারণে কোনো মাসে কোনো শ্রমিক মাসের সব কর্মদিবসে উপস্থিত থাকার পরও নির্ধারিত গ্রেডের প্রাপ্য ন্যূনতম মজুরি অপেক্ষা কম মজুরি পেলে কারখানা কর্তৃপক্ষ তা পূরণ করে দেবে।

মাহবুবুল আলম বলেন, “মজুরি কাঠামো ২০১৫ অনুযায়ী উৎপাদনের ভিত্তিতে শ্রমিকদের প্রাপ্য সর্বনিম্ন বেইজ রেট দিয়ে হিসাব করা হচ্ছে না। সর্বনিম্ন বেইজ রেটের বেশি উৎপাদনের মূল মজুরি হলে সেক্ষেত্রে কোনো অলস ঘণ্টা দেওয়া হয়ে থাকলে তা কেটে নেওয়া হচ্ছে। এ অনিয়ম দূর করতে হবে।”

পাওনা টাকা এককালীন চান অল্প দিনের শ্রমিকরা

সরকার শ্রমিকদের পাওনা টাকার অর্ধেক নগদ এবং বাকি অর্ধেক মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র আকারে দেওয়ার কথা বললেও অনেকেই তা এককালীন চাইছেন। তারা বলছেন, সঞ্চয়পত্র আকারে টাকা দেওয়া হলে তা তাদের কোনো ‘কাজেই আসবে না’। এককালীন টাকা পেলে উপার্জনের বিকল্প হিসেবে ব্যবসা দাঁড় করাতে পারবেন বলে যুক্তি দিচ্ছেন তারা।

খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিলের শ্রমিক আন্দোলনের নেতা অলিয়ার হোসেন বলেন, “যারা অবসরে যাবেন, তাদের জন্য সঞ্চয়পত্র ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের যাদের চাকরির বয়স কম, বড় জোর ৫-৬ বছর, তাদের পাওনা মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা। আমাদের টাকাটা এককালীন দিয়ে দিলেই ভালো হবে।

“আমরা নতুন করে আবার পাটকলে চাকরি পাব, সে আশা করি না। সেক্ষেত্রে পাওনা টাকা একসাথে পেলে সেটা দিয়ে একটা বিকল্প ব্যবসা শুরু করতে পারি।”

একই কথা বলেন খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের নূর ইসলাম।

“আমাদের চাকরি আর ফেরৎ পাব বলে মনে হয় না। সে টাকাটা একসঙ্গে দিলে আমরা নষ্ট করে ফেলব, একথা আসলে সত্যি না। এ টাকা একসাথে পেলে নতুন ব্যবসা শুরু করতে পারি। সঞ্চয়পত্র করে দিলেই আসলে জটিলতা তৈরি হবে। শ্রমিকদের অনেকেই এসব জটিলতা বুঝবে না। পাওনা টাকাটা ঠিকমতো নাও পাইতে পারে তখন।”

তবে পাট-সুতা ও বস্ত্র শ্রমিক-কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক পাটকল আন্দোলনের শ্রমিক নেতা শহীদুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, শ্রমিকদের অর্ধেক টাকা সঞ্চয়পত্র আকারে দিলেই ভালো হয়।

“পুরো টাকাটা একসঙ্গে দিলে নষ্ট করে ফেলবে।”