প্রণব মুখোপাধ্যায়: বাংলাদেশের বন্ধু, ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি

স্বাধীনতা সংগ্রামী বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে প্রথম বাঙালি হিসেবে ভারতের রাষ্ট্রপতির পদে আসীন প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বন্ধু হয়ে ছিলেন পাশে।

মাসুম বিল্লাহও মীর মোশাররফ হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 August 2020, 01:44 PM
Updated : 1 Sept 2020, 05:22 AM

বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পাওয়ার পর গত ১০ অগাস্ট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৮৪ বছর বয়সী প্রণব মুখোপাধ্যায়। অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে তার শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণও ধরা পড়ে। এক পর্যায়ে তিনি চলে যান গভীর কোমায়। সোমবার তার জীবনের অবসান ঘটার ঘোষণা আসে।

ভারতের বিভিন্ন সরকারে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য ও অর্থের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা বিরল এ রাজনীতিকের প্রজ্ঞা, জ্ঞান, দক্ষতা আর ত্যাগের ভূয়সী প্রশংসা পাওয়া যাবে বিরোধী মত ও দর্শনের রাজনীতিকদের মুখ থেকেও, যা তার ভারতরত্ন খেতাব পাওয়ার যথার্থতা তুলে ধরে।

পশ্চিম বাংলার এই কংগ্রেস নেতা একাত্তরে পাশে দাঁড়িয়ে এপার বাংলার মানুষকেও কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেন। তার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৩ সালে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ দেওয়া হয়।

বিয়ের সূত্রেও বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধনে জড়িয়ে ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, তার স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলাদেশের নড়াইলের সন্তান। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে এসে নড়াইলের ভদ্রবিলায় শ্বশুরালয়েও ঘুরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ‘জামাইবাবু’ প্রণব মুখোপাধ্যায়।

বাংলা একাডেমিতে ২০১৮ সালের ১৫ জুন আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রণব মুখোপাধ্যায় (ফাইল ছবি)

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মিরাটি গ্রামে ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া প্রণবের বাবা কমদা কিঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনও ছিল বর্ণিল। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়ায় বেশ কয়েকবার কারাবরণও করতে হয় এ কংগ্রেস নেতাকে। প্রণবের মায়ের নাম রাজলক্ষ্মী মুখোপাধ্যায়। 

ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর প্রণব মুখোপাধ্যায় (পল্টু) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে আইন বিষয়েও ডিগ্রি নিয়েছিলেন। কিছুদিন কলেজের শিক্ষক ও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করলেও তার আগ্রহ ছিল রাজনীতিতে। 

শুরুতে বাংলা কংগ্রেসের হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন; ১৯৬৯ সালে রাজ্যসভায় প্রথমবার সদস‌্যও হন এ দলের থেকে। অবশ্য দ্রুতই তিনি ইন্দিরা গান্ধীর নজর কাড়তে সক্ষম হন, হয়ে ওঠেন কংগ্রেসের অন্যতম প্রভাবশালী চরিত্র। যে কারণে পরের কয়েক দশকের বেশিরভাগ সময়ই বীরভূমের পল্টুকে দল, পার্লামেন্ট আর সরকারের নানান দায়িত্ব সামলাতেই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।

১৯৭৮ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত সর্বভারতীয় কংগ্রেসের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কমিটির সভাপতিও হন। ইন্দিরা মারা যাওয়ার পর একবার দল থেকে বিতাড়িতও হয়েছিলেন, ফেরেন ১৯৮৯ সালে।

২০০০ সালে অগাস্টে ফের প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পান, সেবার এ পদে থাকেন এক দশক। ১৯৭৮-১৯৮৬ এবং ১৯৯৭-২০১২ দুই মেয়াদে কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবেও তিনি দুই যুগেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।   

১৯৮২ সালে তিনি প্রথমবার অর্থমন্ত্রী হন। সেসময় ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভার এ সদস্য ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সংসদ নেতাও ছিলেন। ভারতের রিজিওনাল রুরাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ফর এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট গঠনেও তার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। 

প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন রাষ্ট্রপতি। নয়া দিল্লিতে রাজীব গান্ধীর মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধীও একই ফ্রেমে। ছবি: ইনডিয়ান এক্সপ্রেস

১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান, ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত বাণিজ্যমন্ত্রী, ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ফের ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন প্রণব।

২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত তিন বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা এ কংগ্রেস নেতা ২০০৪ সাল থেকে পরের ৮ বছর লোকসভার সংসদ নেতা ছিলেন। 

৫ বার রাজ্যসভার সদস্য ও দুই বার লোকসভার সদস্য হওয়া প্রণবের নাম ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার তালিকায় বারবার উঠলেও তা হয়ে ওঠেনি।

শেষশেষ ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পথ খোলে তার; ওই বছরের জুলাইয়ে ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার মেয়াদ শুরু হয়।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিত এ বাঙালি রাজনীতিক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের বোর্ড অব গভর্নরসেও ছিলেন। 

১৯৮২, ১৯৮৩ ‍ও ১৯৮৪ সালে কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলন, ১৯৯৪, ১৯৯৫, ২০০৫ ও ২০০৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ, নিউ জিল্যান্ডের অকল্যান্ডে ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলন, একই বছর কলম্বোয় জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন এবং ১৯৯৫ সালে বান্দুংয়ে আফ্রো-এশীয় সম্মেলনের ৪০তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্নেহধন্য। ছবি: ইনডিয়ান এক্সপ্রেস

প্রণব ২০০৮ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মবিভূষণ পান। তিনি ১৯৯৭ সালে সেরা সাংসদ এবং ২০১১ সালে ভারতের সেরা প্রশাসকের পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে প্রণব ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ভারতরত্ন পান।   

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, রাশিয়ান ডিপ্লোমেটিক অ্যাকাডেমি, বেলারুশ স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, জর্ডান বিশ্ববিদ্যালয়, ফিলিস্তিনের আল-কুদস বিশ্ববিদ্যালয়, ইসরায়েলের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় ও নেপালের কাঠমান্ডু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক বিভিন্ন ডিগ্রি পাওয়া প্রণব অল্প কিছু দেশ ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব দেশই ভ্রমণ করেছেন বলে তার ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে। 

১৯৮৪ সালে নিউ ইয়র্কভিত্তিক ‘ইউরো মানি’ জার্নালের এক জরিপে প্রণব সেসময় বিশ্বের সেরা ৫ অর্থমন্ত্রীর একজন মনোনীত হয়েছিলেন। ‘ইমার্জিং মার্কেটস’ জার্নাল তাকে ২০১০ সালে এশিয়ার সেরা অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিল।

২০১৭ সালের জুলাইয়ে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হওয়া এ রাজনীতিকের লেখা বইয়ের মধ্যে আছে- বিয়ন্ড সার্ভাইভাল: ইমার্জিং ডাইমেনশনস অব ইন্ডিয়ান ইকোনমি, অব দ্য ট্র্যাক, সাগা অব স্ট্রাগল অ্যান্ড স্যাক্রিফাইস, চ্যালেঞ্জেস বিফোর দ্য নেশন, থটস অ্যান্ড রিফ্লেকশনস, দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস, দ্য টার্বুলেন্ট ইয়ারস ১৯৮০-১৯৯৬ ও দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২।  

শেখ হাসিনার উষ্ণ অভ্যর্থনায় প্রণব মুখোপাধ্যায় (ফাইল ছবি)

বাংলাদেশের বন্ধনে জড়িয়ে

মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কংগ্রেসের নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন রাজ্যসভার সদস্য। ভারতের অনেক রাজনীতিকের মতো তখন মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।

একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে ফ্রান্সে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এবং পাকিস্তানিদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।

একই সময়ে যুক্তরাজ্য ও জার্মানি সফরে গিয়ে সেখানকার সরকার প্রধান ও সংসদ সদস্যদের কাছে বাংলাদেশের তখনকার পরিস্থিতি উপস্থাপনে ভূমিকা রাখেন তিনি।

ওই সময়ে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো করায় ভূমিকা রাখেন তিনি।

সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রণব মুখোপাধ্যায় (ফাইল ছবি)

নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস’ এ একটি অধ্যায়ই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

প্রণব লিখেছেন, “বাজেট অধিবেশন চলাকালে আমি রাজ্যসভায় বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিই। আমি বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া। আমি সংসদকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করার বহু নজির আছে।”

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধু হিসেবে ২০১৩ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশের তখনকার রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাতে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ তুলে দেন। 

সেই অনুষ্ঠানে তার অবদান স্মরণ করে জিল্লুর রহমান বলেন, “আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি প্রত্যক্ষভাবে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে আপনার অমূল্য অবদানের কথা স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

“তাই আজকের এ সম্মাননা আপনার অবদানের বিনিময় নয়। বরং সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে সামান্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।”

প্রণব মুখোপাধ্যায়কে যখন মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দেওয়া হয়, তখন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম।

মুক্তিযুদ্ধকালে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকার কথা স্মরণ করে এই আওয়ামী লীগ নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভারতের জনগণকে দীর্ঘদিন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের খরচের জন্য পণ্য কিনলে লেভি দিতে হত। এই জিনিসগুলো কিন্তু এই নেতৃবৃন্দ সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এটা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।”

তিনি বলেন, “বিশ্ব সম্প্রদায়ের সাপোর্ট আমাদের অনুকূলে আনার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার, চীন সরকারের শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিশ্ব জনমত গঠন করা খুব সাংঘাতিক কঠিন ছিল।”

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রবীণ রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে তিনি খুব পাওয়ারফুল মন্ত্রী ছিলেন। উনি ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।

“তিনি বাংলাদেশের এক বিশ্বস্ত বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধে উনি ভালো ভূমিকা রেখেছে। যার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দিয়েছি তাকে।”

চট্টগ্রামের রাউজানে অগ্নিযুগের বিপ্লবী সূর্যসেনের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে প্রণব ‍মুখোপাধ্যায় (ফাইল ছবি)

বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পঁচাত্তরে হত্যা করার পর তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পাশেও দাঁড়িয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

সেই সম্পর্কের কথা তিনি লিখে গেছেন তার বইয়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার কঠিন সময়েও বন্ধু হয়ে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন পাশে।

প্রণব লিখেছেন, “শেখ হাসিনা আমার ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু এবং আমি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে ভারত সহায়তা করেছিল।”

২০০৭-০৮ সালের জরুরি অবস্থার সময়কার পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “যখন কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা তাকে (শেখ হাসিনা) ত্যাগ করছিলেন, আমি তাদের ভর্ৎসনা করে বলি, যখন কেউ বিপদে পড়েন, তখন তাকে ত্যাগ করা অনৈতিক।”

সেই স্মৃতি স্মরণ করে শেখ হাসিনা শোক বার্তায় বলেছে, “১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ভারতে নির্বাসিত থাকাকালীন প্রণব মুখার্জি আমাদের সব সময় সহযোগিতা করেছেন। এমন দুঃসময়ে তিনি আমার পরিবারের খোঁজ-খবর রাখতেন এবং যে কোনো প্রয়োজনে আমার ছোট বোন শেখ রেহানা ও আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।

“দেশে ফেরার পরও প্রণব মুখার্জি সহযোগিতা এবং উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি আমাদের অভিভাবক ও পারিবারিক বন্ধু। যে কোনো সংকটে তিনি সাহস যুগিয়েছেন।”

বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে প্রণব মুখোপাধ্যায় (ফাইল ছবি)

’দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২’ বইতে এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকার সরিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা ও দুই নেত্রীর মুক্তিসহ নানা দিক নিয়ে লিখেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

ওই আত্মজীবনীতে তিনি লেখেন, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়ের মুক্তির বিষয়ে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাতে যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন তিনি।

তার সেই ভূমিকার বিষয়ে এ বি তাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওয়ান-ইলেভেনের পরে উনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশের নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনটা যেন সুষ্ঠুভাবে হয়, সেক্ষেত্রে উনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।”

ভারতসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতার কথাও তার মৃত্যুর ঘুরে ফিরে আসছে রাজনীতিকদের কথায়।

প্রবীণ রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ বলেন, “উনার বড় গুণ হইল, উনি দলমত নির্বিশেষে সকলেরই আস্থা এবং বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। পরে রাষ্ট্রপতি হলেন কংগ্রেসের শাসনামলে, কিন্তু বিজেপিও তাকে সম্মানের চোখে দেখত। একটি দলের নেতা হলেও দলমত নির্বিশেষে সকলেরই আস্থা অর্জন করেছিলেন।”

স্ত্রীকে নিয়ে নড়াইলে প্রণব মুখোপাধ্যায় (ফাইল ছবি)

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী শুভ্রা পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত নিজের গ্রাম নড়াইলের ভদ্রবিলায় কাটিয়েছিলেন। এরপর নানা বাড়িতে থেকে স্থানীয় চাঁচড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করেন। পরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভারত চলে যান।

প্রণব ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই শুভ্রা ঘোষকে বিয়ে করেন। ওই সময় তারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তাদের দুই ছেলে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় ও সুরজিৎ মুখোপাধ্যায় এবং এক মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়।

শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে ২০১৩ সালে প্রণব সস্ত্রীক নড়াইলের ভদ্রবিলায় এসে শ্বশুরালয়ও ঘুরে যান। তার আগে ১৯৯৬ সালে মেয়ে শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়িয়ে যান শুভ্রা।

২০১৩ সালের ৫ মার্চ শ্বশুর বাড়ি ঘুরে যাওয়ার পর নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে স্ত্রীর নামে একটি তিনতলা ছাত্রী হোস্টেল করে দিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এছাড়া শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের নানাবাড়ি চাঁচড়ায় একটি মন্দির ও একটি হাইস্কুলে ভবন নির্মাণ করে দিয়েছেন তিনি।

আত্মীয়তার এই বন্ধনকে স্মরণ করে ২০১৩ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তৃতায় প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আমার শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে গাঁথা এবং আমি এর ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আত্মভূত করেছি। আমার স্ত্রীর জন্ম নড়াইলে এবং এখানেই তিনি লেখাপড়া শুরু করেন।”

তিনি আরও বলেন, “আমি বড় হয়েছি আপনাদের মতো একই সাহিত্যিক ও কবিদের লেখা পড়ে, সেসব গান শুনে যা আমাদের উভয় দেশের জনগণ ভালোবাসেন, ঘুরে বেড়িয়েছি একই নদীর তীরে, যা একই রকম গানের জন্ম দেয়, যা আমাদের মনকে একই রকমভাবে ভাবিত করে তোলে।”