সরকারি গেজেটে জাতীয় কবির স্বীকৃতির দাবি নজরুল পরিবারের

মৃত্যুর ৪৪ বছর পরেও কাজী নজরুল ইসলামের জাতীয় কবির স্বীকৃতি সরকারি গেজেটে না আসায় হতাশা প্রকাশ করেছেন কবি পরিবারের সদস্যরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 August 2020, 06:21 AM
Updated : 27 August 2020, 07:24 AM

কবির নাতনী খিলখিল কাজী বলেছেন, এভাবে চললে কয়েক যুগ পর নব প্রজন্ম জাতীয় কবিকে বিস্মৃত হতে পারে। সে কারণেই সরকারি গেজেটের মাধ্যমে জাতীয় কবির স্বীকৃতি হওয়া উচিৎ।

বাংলা ভাষার কবিতাপ্রেমিদের কাছে নজরুল প্রেমের কবি, চির যৌবনের দূত; সেইসঙ্গে তিনি বিদ্রোহী, গৃহত্যাগী বাউণ্ডুলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত।

১৯৭৬ সালের ২৯ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় কবির। বৃহস্পতিবার তার ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।

কবির নাতনী খিলখিল কাজী সকালে টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৫ -১৬ বছর হয়ে গেছে এটা নিয়ে (সরকারি গেজেট) কথা বলছি। সরকারিভাবে এটা এখনও করা হয়নি। আমার বক্তব্য, তিনি জাতীয় কবি, সরকারিভাবে গেজেট করা দরকার, আমি তা মনে করি। আমাদের পরিবারের দাবি এটা।”

১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম।

বৈচিত্র্যময় এক জীবনের অধিকারী নজরুল ছেলেবেলায় পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘দুখু মিয়া’ নামে। পিতৃহীন কবি একে একে হারিয়েছেন কাছের স্বজনদের। আর্থিক অসচ্ছলতা তার জীবনকে কঠিন করে তুলেছিল। 

সব বাধা অতিক্রম করে একসময় তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা হয়ে ওঠেন। সাম্য ও মানবতার চেতনায় সমৃদ্ধ ছিল তার লেখনী। কবিতায় বিদ্রোহী সুরের জন্য হয়ে ওঠেন ‘বিদ্রোহী কবি’।

খিলখিল কাজী বলেন, “নজরুলের যে জীবন দর্শন ছিল, তার সৃষ্টি পাঠ করলে আমাদের যা চোখে পড়ে তা হল দেশকে ভালোবাসা, দেশের মানুষকে ভালোবাসা। কবি নজরুল শিখিয়ে গেছেন চির উন্নত শির হতে, মানুষকে ভালোবাসতে। অন্যায়, অবিচার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি তার কলমকে মজবুত রেখেছিলেন।

“চির অকুতোভয় কবি ভয়ঙ্কর সে যুগে এককভাবে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। তার গান, কবিতা সবসময়ে সমাজ বদলানের হাতিয়ার। তিনি সকল বাঙালির, সকল মানুষের “

বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কবির সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান। সেখানে নজরুল সংগীত শিল্পী ফেরদৌস আরার কথায়ও জাতীয় কবির সরকারি স্বীকৃতির প্রসঙ্গটি আসে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নজরুল সংগীত শিল্পী ফেরদৌস আরা।

তিনি বলেন, “কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয় কবি, তা আমাদের মেধায় আছে, মননে আছে। কিন্তু তা কোনো সরকারি গেজেটে নেই। অনেকের কথা থাকে- লিখিত রাখার কি দরকার আছে? আমরা তো জানিই যে তিনি জাতীয় কবি। সে কথাই যদি হত, তাহলে কোথাও কোনো স্বীকৃতির প্রয়োজন হত না। কোথাও কোনো কাগজে লিখতে হত না। স্বাক্ষর-সিলের কোনো দরকার ছিল না। কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয় কবি সে হিসেবেই স্বীকৃতি হওয়া উচিৎ।

“স্বাধীনতার এত বছর পরেও, আজকে তার ৪৪ তম মৃত্যুবার্ষিকী, এত দিনেও আমরা তাকে স্বীকৃতি দিতে পারিনি, এ লজ্জা আমাদের সবার।”

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর দলের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক, পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, “কাজী নজরুল ইসলাম অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক। আমাদের চেতনায় নজরুল চিরজাগরুক থাকবেন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

“তার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় এই দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বৃক্ষের মূলোৎপাটন করব বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। একইসাথে নজরুলের চেতনায় সমৃদ্ধি ও সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণ করব।”

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে কবির সমাধিতে এসেছিলেন সচিব বদরুল আরেফীন। পরে তিনি বলেন, “কবি নজরুল শুধু বিদ্রোহী কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন শান্তি ও সম্প্রীতির কবি। তিনি ছিলেন সমস্ত সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে। নজরুলের কীর্তি ও রচনা চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের সাহিত্য অঙ্গনকে আরও এগিয়ে নেব।”

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর দলের ‍যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “যখন গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, তখন কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের উদ্বুদ্ধ করেন স্বেচ্ছায় নির্যাতন ভোগ করার। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত। দুঃশাসনের এ যুগে কাজী নজরুল আমাদের প্রতিটি ক্ষণে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন, এ দুঃসময়কে অতিক্রম করার জন্য, সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের পাশেই আছেন।

“তিনি আছেন বলেই এ নির্যাতন, নিপীড়নের মধ্যেও আমরা মিছিল করছি, সত্য উচ্চারণ করছি। তিনি আছেন বলেই আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই করছি।”

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, “ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে প্রেরণার এক অসাধারণ উৎস হিসেবে রয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের কঠিনতম সময়ে নজরুলের গান, কবিতা অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। বঙ্গবন্ধু নিজেও তার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। যখন তাকে ঢাকায় আনা হল, তখন বাংলাদেশ নামটির সঙ্গে নজরুলের নামটির মেলবন্ধন আরও দৃঢ় হল।

“আমরা যখন দুঃসময়ের মুখোমুখি হই, বাস্তবতার মুখোমুখি হই, তখনই কবির অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক ও মানবিক বোধসম্পন্ন সৃষ্টি আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়।”

শৈশবে পিতৃহারা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় গ্রামের মক্তবে। পরিবারের ভরণ-পোষনের জন্য মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ নেন।

রাঢ় বাংলা (বর্ধমান-বীরভূম) অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গীক লোকনাট্য লেটো দলে যোগ দেওয়ার কিছু দিনের মধ্যে নজরুলের শিক্ষকতার সমাপ্তি ঘটে। ওই সময়ই তাৎক্ষনিক কবিতা ও গান লেখার দক্ষতার জন্য পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।

১৯১০ সালে লেটো গানের দল ছেড়ে দিয়ে প্রথমে রানীগঞ্জ সিয়ারসোল স্কুল এবং পরে মাথরুন স্কুলে (নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউশন) ভর্তি হলেও আর্থিক অনটনের কারণে আবারও আসানসোলে চা-রুটির দোকানে কাজ নিতে হয় নজরুলকে। সেখানেই আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

রফিজউল্লার আগ্রহে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে দরিরামপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন নজরুল। সেখানে এক বছর ছিলেন তিনি। সেই ত্রিশালেই নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রবেশিকা শেষ না করেই ১৯১৭ সালের শেষ দিকে স্কুল ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নজরুল। ১৯২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর চলে তার সেই সামরিক জীবন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা 'বিদ্রোহী'। ব্রিটিশ রাজের ভিত কেঁপে উঠেছিল তার অগ্নিগর্ভ কবিতার বজ্রনির্ঘোষে। ব্রিটিশবিরোধী লেখার জন্য বেশ কয়েকবার কারারুদ্ধ হতে হয় তাকে।

একে একে প্রকাশিত হতে থাকে তার গ্রন্থ অগ্নিবীণা, প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, ছায়ানট, বিষের বাঁশি, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী, ব্যথার দান, ঘুমের ঘোরে, মৃত্যুক্ষুধা।

নজরুল প্রতিভার আরেকটি দিক প্রভা ছড়িয়েছে সংগীতে। শ্যামা সংগীত ও ইসলামী গজল- দুই ধারাতেই সমান দখল দেখানো নজরুলের লেখা গানের সংখ্যা চার হাজারের বেশি।

সৈনিক জীবনের সমাপ্তির পর নজরুলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহমদের সঙ্গে। সে সময় তিনি সাপ্তাহিক লাঙ্গল, গণবাণী, ধূমকেতু, সওগাত ও সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন।

নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।

১৯২১ সালে কুমিল্লায় প্রমীলা দেবীর সঙ্গে পরিচয়ের তিন বছর পর পরিণয়। কবি পরিবারে আসেন কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ।

১৯৪২ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ বাকশক্তি হারান নজরুল। স্বাধীনতার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ কবিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুল হন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।