বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় মোশতাকের সহযোগী ছিলেন জিয়া: শেখ হাসিনা

পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পেছনে উচ্চাভিলাষী খন্দকার মোশতাকের সহযোগী হিসেবে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2020, 03:29 PM
Updated : 16 August 2020, 04:46 PM

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রোববার বিকালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডে সেইদিন কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশীদ, মেজর হুদা, মেজর ডালিম, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা সামরিক অফিসার এরা সকলেই যেমন, মহিউদ্দিন, মাজেদ, মোসলেহউদ্দিন, রাশেদ, খায়রুজ্জামানসহ সকলেই জড়িত ছিল।”

কিন্তু এই সামরিক অফিসারদের কারা, কে মদদ দিয়েছিল এবং তাদের পেছনে কে ছিল- প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “আমার বাবার কেবিনেটেরই এক মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক, তার উচ্চাভিলাষ আর তার সহযোগী জিয়াউর রহমান, যে একজন মেজর ছিল, যাকে প্রমোশন দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মেজর জেনারেল বানিয়েছিলেন, সে এর সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিল।

“সেটা স্পষ্ট পাওয়া যায় এই হত্যাকাণ্ডের পর…কর্নেল ফারুক এবং কর্নেল রশীদ তারা একটা ইন্টারভিউ দেয়, যেখানে তারা স্পষ্ট বলে যে তাদের সঙ্গে জিয়াউর রহমান সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিল এবং তার মদদেই তারা এই ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হয়েছে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “…সেটা আরও প্রমাণ হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, তিনি রাষ্ট্রপতি… তাকে হত্যার পর সেখানে সংবিধান মানা হয়নি। ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব কিন্তু রাষ্ট্রপতি হননি। রাষ্ট্রপতি ঘোষিত হল খন্দকার মোশতাক। আর খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়েই জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বানালো সেনাবাহিনীর প্রধান।

“জেনারেল জিয়াউর রহমান মোশতাকের সাথে যদি এই ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ত না থাকে তাহলে কেন মোশতাক তাকেই বেছে নেবে সেনাপ্রধান হিসেবে? ওই খুনিদের সব ধরনের মদদ দেওয়া…এটা তো জিয়াউর রহমানই দিয়েছিল। এখানেই তো তাদের শেষ না। মোশতাক..বেঈমানরা কখনও ক্ষমতায় থাকতে পারে না। মীর জাফরও পারেনি। মীর জাফরকে যারা ব্যবহার করেছিল সিরাজদ্দৌল্লাকে হত্যা করতে…মীর জাফর দুই মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ঠিক মোশতাকও পারেনি।”

খন্দকার মোশতাককে সরিয়ে জিয়াউর রহমান আইন লঙ্ঘন করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল জানিয়ে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এই খুনিরা যারা শুধু ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ড ঘটায়নি, ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যারা হত্যাকাণ্ড ঘটায়, তাদেরকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া, তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, ব্যাংকক হয়ে তাদেরকে লিবিয়াতে পাঠানো এবং সেখান থেকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে…জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়েই এই খুনিদেরকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে।”

জিয়াউর রহমান জাতির পিতার খুনিদের রক্ষায় ইনডেমনিটি আইন করেছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রোববার আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় ভিডিও কনফারেন্সে বক্তব্য দেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: সাইফুল ইসলাম কল্লোল

জাতির জনকের দুই কন্যা যখন শরণার্থী হিসেবে বিদেশে অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিল তখন খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে সরকারি চাকরি দিয়ে পুরষ্কৃত করা হয়েছিল বলে জানান শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “আশিসালে আমি লন্ডনে যাই।.. ৮০ সালের ১৬ই অগাস্ট আমরা লন্ডনে এই হত্যার প্রতিবাদে একটা শোকসভা করি এবং সেই সময় ওখানে স্যার টমাস ইউলিয়াম কিউসি এমপি এবং নভেল লরিয়েট শন ম্যাক ব্রাইট… তাদেরকে নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়।

“প্রবাসী বাঙালিদের সহযোগিতায়..সেই তদন্ত কমিশনের প্রতিনিধি হিসেবে স্যার টমাস উইলিয়ামসকে বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হত্যার তদন্ত করার জন্য পাঠানো হয়। ব্রিটিশ এমপি, অনেকে তখন আমাদের সহযোগিতা করে এবং তিনি যখন ভিসা চান জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্রপতি, জিয়াউর রহমান কিন্তু স্যার টমাস উইলিয়ামসকে ভিসা দেয় নাই।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জিয়াউর রহমান কেন ভিসা দিল না? কেন তদন্ত করতে দিল না? এই প্রশ্নটাও থেকে যায়। কারণ খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল বলেই সে ভীত ছিল। সেজন্য সে এটা তদন্ত করতে দেয়নি। ঠিক এইভাবেই খুনিদেরকে তারা লালন পালন করে গেছে।”

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, “জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিল কিন্তু তার সঙ্গে পাকিস্তানীদের সংযোগ ছিল।”

সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল বেগের জিয়াউর রহমানকে লেখা একটি চিঠি পড়ে শোনালে সেই চিঠির প্রসঙ্গ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “সেই কর্নেল বেগ..পরবর্তীকালে এই বেগ কিন্তু পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হয়। সে বাহবা দিচ্ছে, ধন্যবাদ দিচ্ছে এবং জিয়াউর রহমানের স্ত্রী ও তার পুত্ররা যে তাদের কাছে খুব ভালো আছে সে কথাটাও জানাচ্ছে।

“ওই চিঠিতে জিয়াকে নতুন কাজ দেওয়ার অঙ্গীকার করা হচ্ছে। সেই কাজটা কি ছিল? তাহলে সেই কাজটা কি এই ছিল যে…স্বাধীনতার সমস্ত চেতনাকে নস্যাৎ করবে? আর এভাবেই এদেশের মানুষ যদি বিজয় অর্জন করে সেই বিজয়কে নস্যাৎ করবে? আর এদেশের স্বাধীনতাকে ভুলুন্ঠিত করবে? এটাই কি তাদের কাজ ছিল? এই কাজটাই সে পেয়েছিল? যার জন্যে ১৫ অগাস্টের মত ঘটনা ঘটে?”

জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ারও সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা।

“জিয়াউর রহমান যেটুকু করে গিয়েছেন তারপর তার স্ত্রী আসার পর তো আরও বেশি। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে কি করেছে? সকলে নিশ্চয়ই ভুলে যাননি।”

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রোববার আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় দলের শীর্ষ নেতারা

১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুযারি ভোটারবিহীন নির্বাচনে কোনো দল অংশ নেয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “নামকাওয়াস্তে কিছু দল জুড়ে দিয়ে একটা নির্বাচনের নামে প্রহসন করা হয়েছিল। সারা বাংলাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে সেই নির্বাচন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ভোটাররাও ভোট দিতে আসেনি।

“তারপর খালেদা জিয়া নিজেকে নির্বাচিত ঘোষণা দেন। আর সেই নির্বাচনে কর্নেল রশীদকে নির্বাচিত করা হলে, মেজর হুদাকে নির্বাচিত করা হল। তাদেরকে পার্লামেন্টে বসানো হল এবং সেই খুনি কর্নেল রশীদকে বিরোধীদলের আসনে বসানো হয়েছিল।”

খুনিদের প্রতি খালেদা জিয়ার এত দরদ কেন, প্রশ্ন রাখেন শেখ হাসিনা।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে এসে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে জানিয়ে তিনি বলেন, “সেই খুনিদের তালিকায় যারা ছিল অনেকে বিদেশে। পাশা, সে মারা যায় বিদেশে। আর খায়রুজ্জামান সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।”

পাশা মারা গেলেও তাকে পদোন্নতি দেয়া এবং খায়রুজ্জামানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে পুনর্বহাল করার কথা তুলে খালেদা জিয়ার সমালোচনা করেন তিনি।

“তার স্বামী যা করেছে…জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারী…তাদের ইনডেমনিটি আর সে এসে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে তাদের ইনডেমনিটি দিয়ে গেছে,” বলেন সরকার প্রধান।

সভায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, হাছান মাহমুদ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, মির্জা আজম, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।