বঙ্গবন্ধুরই কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয়েছিল হত্যাকাণ্ডের বিচার। এরপর ১৪ বছর ধরে বিচারের নানা ধাপ পেরিয়ে কার্যকর করা হয় পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড।
খুলল মামলার পথ
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বরের বাড়িতে একদল বিপথগামী সেনার বুলেটে প্রাণ দিতে বঙ্গবন্ধুকে। ঘাতকদের হাত থেকে রক্ষা পাননি বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজি কামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাব ইন্সপেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান, পেট্রোল ডিউটির সৈনিক সামছুল হক ও রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলের।
দেশের বাইরে থাকায় সেদিন প্রাণে বেঁচে যান জাতির পিতার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রেসিডেন্ট হওয়া খন্দকার মোশতাক আহমেদ খুনিদের রক্ষায় ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন, ১৯৭৯ সালে যাকে আইনে পরিণত করেন জিয়ারউর রহমান।
হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ বাতিল করে হত্যাকাণ্ডটির বিচারের পথ সুগম করে।
ওই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির সেই বাড়ির রিসেপনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম (মৃত্যু: ২৫ অগাস্ট, ২০১৬) ঢাকার ধানমণ্ডি থানায় হত্যা মামলা (১০(১০)৯৬) দায়ের করেন ।
তিন মাসের বেশি সময় ধরে তদন্তের সিআইডির সে সময়কার সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল কাহহার আকন্দ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তদন্তে বঙ্গবন্ধু হত্যায় সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ চারজনের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও আগেই তারা মারা যাওয়ায় অভিযোগপত্রে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
১৫ অগাস্টের পর যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যাওয়া খুনি ফারুক-রশিদ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে ১৯৭৬ সালে যে টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ধারণ করা সেই সাক্ষাৎকারের ভিডিওসহ ৪৬ ধরনের আলামত অভিযোগপত্রের সঙ্গে আদালতে জমা দেওয়া হয়। সাক্ষী করা হয় ৭৪ জনকে।
দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ার পর রায়
মামলার বিচারের ২০২ কার্যদিবসে মোট ৬১ জনের সাক্ষ্য নেয় আদালত। মামলাটির প্রধান স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটরের দায়িত্বে ছিলেন বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা মো. সিরাজুল হক। তাকে সাহায্য করেন সৈয়দ রেজাউর রহমান, আনিসুল হক, মোশারফ হোসেন কাজল। আসামিপক্ষে ছিলেন খান সাইফুর রহমান, আব্দুর রেজ্জাক খান, টিএম আকবর প্রমুখ।
নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিলে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাই কোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিভক্ত রায় দেয়। বিচারপতি এম রুহুল আমিন পাঁচ আসামিকে খালাস দিয়ে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন। অপরদিকে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ডই বহাল রাখেন।
বিভক্ত রায় হওয়ায় নিয়মানুযায়ী মামলাটি তৃতীয় বেঞ্চে পাঠান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি। তৃতীয় বেঞ্চের রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।
মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১২ আসামিরা- সাবেক মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) ফারুক রহমান, কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আব্দুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, মেজর (অব.) নূর চৌধুরী, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন খান, লে. কর্নেল (অব.) রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মাজেদ ও লে. কর্নেল আজিজ পাশা (অব.)।
২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করে দেয়।
এরপর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বজলুল হুদা, ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন ও মহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বজলুল হুদাকে থাইল্যান্ড ও মহিউদ্দিন আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হয়।
বাকি আসামিরা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছেন। এদের মধ্যে আজিজ পাশা ২০০২ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন বলে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে খবর এলেও হত্যা মামলার নথিতে তার মৃত্যুর কোনো তথ্য-উপাত্ত না থাকায় তাকে পলাতক দেখানো হয়।
সবশেষ ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মাজেদের।
দুই দশকেরও বেশি সময় ভারতে পালিয়ে থাকার পর এ বছরের ৭ এপ্রিল দেশে ফেরা মাজেদ ঢাকার গাবতলী থেকে গ্রেপ্তার হন। কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গত ১২ এপ্রিল তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।