১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের রক্ষায় একটি অধ্যাদেশ জারি করেন ‘স্বঘোষিত’ রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমেদ।
পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নিয়ে সংবিধান সংশোধন করে খুনিদের রক্ষার পর পথটি স্থায়ী করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ওই ইনডেমনিটি অ্যাক্ট বা দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল করলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ খোলে।
এরপর বিচার প্রক্রিয়া শেষে আদালতের চূড়ান্ত রায় অনুযায়ী ছয় খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তবে মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে পাঁচজন এখনও রয়েছেন পলাতক।
কী ছিল অধ্যাদেশে
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতায় বসে সামরিক আইন জারি করেন বঙ্গবন্ধু সরকারেরই মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক, তার পেছনে ছিল সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা।
দুই অংশের অধ্যাদেশটির প্রথম অংশে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যাই কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
আর দ্বিতীয় অংশে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যায়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হল। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
মোশতাকের পর জিয়ার হাত
এই অধ্যাদেশ জারির পেছনে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের হাত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে; যিনি তার ঠিক আগেই সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
পরবর্তীতে সময়ে সামরিক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল নিজেই রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হয়ে জিয়া ওই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করেন।
এরপর ওই বছরের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাস হয়।
ওই সংশোধনীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত দায়মুক্তি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়।
সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’।
পঞ্চম সংশোধনীতে বলা হয়, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ, ও অন্যান্য আইন, উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশ, কৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ, অথবা প্রণীত, কৃত, বা গৃহীত বলিয়া বিবেচিত আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ঐ সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তত্সম্পর্কে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কারণেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।”
১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ফলে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অঘোষিত রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশটি কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। ফলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধা ছিল না।
সে পথ আটকাতেই জিয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনেন বলে মনে করেন সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা এই হত্যাণ্ডটি সংগঠিত করেছিল, তারাই দায়মুক্ত হতে এই দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি করেছিল।
“সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯-এর ক্ষমতাবলে ভবিষ্যতে কেউ যাতে ১৫ অগাস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে পারে, সে ব্যবস্থাটিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করা হল।”
“নিঃসন্দেহে এই অধ্যাদেশটি ছিল আইনের শাসন বিরোধী,” বলেন তিনি।
যেভাবে বাতিল
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে দীর্ঘ ২১ বছর এই অধ্যাদেশটি বাতিলে রাজনৈতিক বা আইনি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
কেন হয়নি- তার ব্যাখ্যায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি শফিক আহমেদ বলেন, “এটার কারণ ছিল, যারা তাদের (খুনি) রক্ষা করার জন্য অধ্যাদেশটি করেছিল, আর ২১ বছর যেসব সরকার ছিল, তারা কিন্তু তাদের পক্ষেরই বলতে হবে।”
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি বাতিলের আইনগত দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আমিন উল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
ওই কমিটি সিদ্ধান্ত দেয়, দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি বাতিলের জন্য সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। দায়মুক্তি অধ্যাদেশের মতোই প্রায় ১৬টি আইন পঞ্চম সংশোধনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই সংসদে বাতিল করা হয়েছে। সুতরাং ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটিও একই রকমভাবে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই সংসদে বাতিল করা সম্ভব।
কমিটির এই রিপোর্ট আইন কমিশনের মতামতের জন্য পাঠানো হলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এফ কে এম মুনীমের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনও তা সমর্থন করে।
এরপর তৎকালীন আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বিল বাতিলের জন্য ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ নামে একটি বিল সংসদে উত্থাপন করেন। পরে ওই বছরের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশ সংসদে আইনটি পাস হয়। তার মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ খোলে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংসদের অবর্তমানে অত্যাবশকতা দেখা দিলে কেবল রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি তো রাষ্ট্রপতি জারি করেননি।
“জিয়া-মোশতাকের মার্শাল ল’তে সংবিধান স্থগিত করে নাই। সংবিধান অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামের। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কারা অন্তরালে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে হত্যা করার পর সংবিধান অনুযায়ী স্পিকার আব্দুল মালেক উকিলের রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা।
“তারা কেউ না হয়ে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হলেন মোশতাক আহমেদ। মোশতাক আহমেদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী। সুতরাং তার কোনো অধিকার ছিল না রাষ্ট্রপতি হওয়ার বা কোনো অধ্যাদেশ জারি করার। উনি গায়ের জোরে অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন।”
“আইনের ভাষায় এটাকে বলে অস্তিত্বহীন, অবৈধ এবং অসাংবিধানিক। সুতরাং এই অধ্যাদেশটি ছিল অস্তিত্বহীন এবং অবৈধ,” বলেন অ্যাডভোকেট মতিন খসরু।
“দায়মুক্তি অধ্যাদেশ কখনও সংবিধানের অংশ ছিল না। পঞ্চম সংশোধনীতে যেটা করেছিল সেটিকেও পরে আদালতের রায়ে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সুতরাং দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি জন্মগতভাবেই অবৈধ ছিল। এই অধ্যাদেশ রেখেও যদি আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করতাম তাহলেও কোনো অসুবিধা ছিল না,” বলেন তিনি।
“মানুষের মনের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি আমরা জাতীয় সংসদে বাতিল করেছি।”
উচ্চ আদালতেও চেষ্টা খুনিদের
১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ সংসদে পাস হওয়ার পর সৈয়দ ফারুক রহমান ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান তা চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন, পরে তারা দুজনই খুনের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলেন।
১৯৯৭ সালে ২৮ জানুয়ারি হাই কোর্ট ফারুক, রশিদের রিট আবেদনটি খারিজ করে দেয়।
হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গেলে সেসময় পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ শুনানি শেষে রায় দেয়, তাও যায় খুনিদের বিপক্ষে।
পরে সর্বোচ্চ আদালতের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়েও আবার আবেদন করা হয়। ১৯৯৮ সালের ১৯ এপ্রিল আপিল বিভাগ আবেদনটি খারিজ করে ২২টি পর্যবেক্ষণ দিয়ে রায় দেয়।
আপিল বিভাগ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ঘটনা পরবর্তীতে তৈরি হওয়া আইন, যা সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। ফলে এ ধরনের আইন অপরাধ বিচারের জন্য কার্যকর থাকতে পারে না।”
উচ্চ আদালত বলে, “দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি ছিল একটি সাধারণ আইন। এটা সংবিধানের অংশ নয়। কারণ সংবিধান দ্বারা এটি সমর্থিত নয়। কারণ ওই সময়ের অধ্যাদেশ বা ফরমানগুলোকে বৈধ আইন হিসেবে বিবেচনা করার জন্য বলা হয়েছে। এটিকে সাংবিধানিক আইন হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি। ফলে সংসদীয় পদ্ধতিতে আইন বাতিল করার যে এখতিয়ার, তা কখনোই রহিত হয়নি।”
এরপরে আরেক মামলার পর্যবেক্ষণে উচ্চ আদালত বলে, দায়মুক্তি পেতে হলে আগে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে হবে যে সংঘটিত ঘটনা ‘ইচ্ছাকৃত নয়’। এটাই হচ্ছে সংবিধানে প্রদত্ত দায়মুক্তির চেতনা। এর বাইরে অন্য কোনো দায়মুক্তি আইনত হতে পারে না।