থোক বরাদ্দের টাকা রাস্তায় খরচে আগ্রহ বেশি: টিআইবি

গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে সংসদ সদস্যদেরকে যেসব থোক বরাদ্দের প্রকল্প দেওয়া হয় তাতে জবাবদিহিতার চর্চা নেই বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2020, 09:50 AM
Updated : 12 August 2020, 09:50 AM

জার্মানভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানটি বলছে, নজরদারি না থাকায় এসব প্রকল্পের টেন্ডার, ঠিকাদারি, নির্মাণ, প্রকৌশল ও অর্থছাড়সহ সর্বত্র অবারিত অনিয়ম দুর্নীতি হচ্ছে।

সংসদ সদস্যরা এই প্রকল্পের সর্বেসর্বা হওয়ায় একদিকে যেমন স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি জনগণের টাকা খরচ করে নেওয়া এসব উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে দলীয় নেতাকর্মীদের পকেটে।

বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে দৈবচয়ন করা ৫০টি সংসদীয় আসনের থোক বরাদ্দের প্রকল্প পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি গবেষণা প্রতিবেদনের এসব দাবি করেছে টিআইবি।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংসদ সদস্যরা উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। কিন্তু প্রকল্পে তারা বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবেই এখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। জনগণের টাকায় জনগণের জন্য উন্নয়নের প্রকল্পগুলো রাজনীতিকীকরণ ও দলীয়করণ হয়ে যাচ্ছে।

“এসব প্রকল্পে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে কৃষি, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ অনেকগুলো স্কিম থাকলেও মূলত বাস্তবায়নের সময় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে অধিক লাভজনক রাস্তাঘাট নির্মাণকে। এগুলো দেখভালের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো আইনি কাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সেভাবে এগুলোর মূল্যায়ন করেনি। ফলে এখানে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো প্রতিরোধক ব্যবস্থা বা পূর্ব প্রস্তুতিই দেখা যাচ্ছে না। দুর্নীতির একটা অবারিত চর্চা হচ্ছে এসব প্রকল্পে।“

গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, “এসব প্রকল্পের মাধ্যমে সংসদ সদস্যরা তাদের স্থানীয় রাজনীতি পাকাপোক্তকরণের কাজ এগিয়ে নিয়ে থাকেন। সর্বপরি জনগণের অর্থে পরিচালিত উন্নয়নের পরিকল্পনার সঙ্গে রাজনীতিকে একাকার করে দেওয়ার একটা চিত্র আমরা খুঁজে পেয়েছি।“

এই প্রকল্পে থেকে সংসদ সদস্যদের দূরে রাখা অথবা এগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য একটি নীতিগত ও প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার সুপারিশ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।

বলেন, “প্রায় ১৫ বছর ধরে এই বিতর্কিত স্কিমগুলো চালু আছে। আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্যদেরকে এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা বাঞ্ছনীয়, সবচেয়ে ভালো হয় যদি এসব প্রকল্প থেকে সংসদ সদস্যদের দূরে রাখা যায়। কিন্তু এটা এখন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে তাই গত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ঘাটতিগুলো মূল্যায়ন করে একটি প্রতিষ্ঠানিক নীতিকাঠামো তৈরি করা উচিত।”

আইআরআইডিপি কী?

২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে সংসদ সদস্যদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে প্রতি সংসদ সদস্যের অনুকূলে দুই কোটি টাকার তহবিল বরাদ্দের অনুমোদন হয়, পরে সেই বরাদ্দের টাকা ৩ কোটি এমনকি ৫ কোটিতেও উন্নীত হয়। এটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বা আইআরআইডিপি নামে পরিচিত।  গ্রামীণ সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন, সেতু কালভার্ট নির্মাণ, গ্রোথ সেন্টার, হাটবাজার উন্নয়ন, কৃষি ও অকৃষি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা, কৃষি অকৃষি পণ্যের বিপণন সুবিধা বৃদ্ধি ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান ত্বরান্বিত করা এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে (২০১০-২০১৪) তিন কোটি টাকা করে ৩০০ আসনের সংসদ সদস্যদের জন্য এই প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় মেয়াদে সিটি করপোরেশন এলাকার ১৬টি আসন ছাড়া বাকি ২৮৪টি আসনে ৫ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তৃতীয় মেয়াদে ২৮০টি সংসদীয় আসনে ৫ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয় যা গত জুনে একনেক সভায় অনুমোদন পেয়েছে।

গবেষণার ব্যপ্তি

গবেষক দলের প্রধান জুলিয়েট রোজেটি বলেন, ২০১৯ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়ে সেগুলোর বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

পরিমাণ বাচক ও গুণবাচক দুই রকম তথ্য নিয়ে একটি মিশ্র পদ্ধতির গবেষণা করেছে টিআইবির গবেষক দল। আইআরআইডিপি-১ এর ৪৬৪টি স্কিম এবং আইআরআইডিপি-২ এর ১৬৪টি স্কিমের কাজের ওপর পর্যবেক্ষণ চালিয়ে এই গবেষণা প্রস্তুত করার দাবি করছেন তারা।

মন্ত্রণালয়, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী বিভাগ, ঠিকাদার, এলজিইডি, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, সংসদ সদস্য, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসহ মোট ৩৪১টি সাক্ষাতকার এতে যুক্ত হয়েছে। ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০টি আসনে কাজ করা হয়েছে।

গবেষণার ফলাফল

গবেষণায় দেখা যায়, আইআরআইডিপি-১ প্রকল্পে ৬০ শতাংশ রাস্তাঘাট নির্মাণ, ১০ শতাংশ সেতু/কালভার্ট, ১ শতাংশ হাটবাজার এবং ২৯ শতাংশ রাস্তা ও ড্রেনেজ নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছে। আইআরআইডিপি-২ প্রকল্পে ৬২ শতাংশ রাস্তাঘাট, ২ শতাংশ সেতু কালভার্ট, ৩৬ শতাংশ রাস্তা, কালভার্ট, ড্রেনেজ নির্মাণ করা হয়েছে।

আইআরআইডিপি-১ প্রকল্পে ৭২ শতাংশ ও প্রকল্প -২ এর ৮৫ শতাংশ স্কিমে অতিরিক্ত এক বছর করে সময় বেশি লেগেছে।

প্রকল্প এলাকায় কাজের বর্ণনা দিয়ে কোনো তথ্যবোর্ড টানানো দেখা যায়নি। কোনো কোনো প্রকল্পে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কাজ সাব কন্ট্রাকটিংয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে ৭৬ শতাংশ স্কিমে কাজ চলাকালে তদারকি হয়েছে। এলজিইডির প্রকৌশলীরা ৭০ শতাংশ, কার্য সহকারীরা ১৭ শতাংশ, ইউপি মেম্বার, পৌরচেয়ারম্যানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ১৩ শতাংশ পর্যবেক্ষণ করেছেন। বাকি পর্যবেক্ষকদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।

পর্যবেক্ষণে স্কিমের কাজ পুরোপুরি না করা, কোনো কেনো স্কিমে একেবারেই না করা, এক বছর পর কাজ শেষ না করে জামানতের টাকা উত্তোলনে কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়েছে বলে পর্যবেক্ষণের তথ্য।

প্রতিবেদনে কাজের মান সন্তোষজনক উল্লেখ করা হলেও টিআইবি বলছে এসব কাজের মধ্যে সম্পূর্ণ কাজ হয়েছে ৭৪ শতাংশে, আংশিক হয়েছে ২১ শতাংশে প্রায় ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো কাজই হয়নি।

প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঠিকাদারকে একেকটি স্কিম বাস্তবায়ন করতে ১৪টি ধাপে অবৈধ কমিশন খরচ করতে হয়।  শতকরা হারে ৮ থেকে ১২ শতাংশ অর্থ এসব ধাপে খরচ করতে হয়। টাকার অঙ্কে এর ধারণামূলক পরিমান মোট ৪১ হাজার টাকা থেকে ৫৯ হাজার টাকা পর্যন্ত।