‘স্বাভাবিকতায়’ ফেরা আদালতের প্রথম দিন

করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেই স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফেরার প্রথম দিনে ঢাকার আদালত প্রাঙ্গন আর এজলাসে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বলয় দেখা না গেলেও জেদের পরিচিত জায়গায় ফিরতে পেরে সন্তুষ্ট আইনজীবীরা।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 August 2020, 02:59 PM
Updated : 5 August 2020, 02:59 PM

সেই সঙ্গে তারা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বিচারক, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী- সবাইকে সুরক্ষা দিতে ভৌত অবকাঠামো গড়ে তুলতে উদ্যোগী হওয়ার পরামরশ দিয়েছেন।

প্রায় চার মাস পর স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরলো নিম্ন আদালত। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের ‘প্র্যাকটিস নির্দেশনার’ আলোকে গত ১১ মে থেকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের অধস্তন এবং ১২ মে থেকে উচ্চ আদালতে বিচারকাজ শুরু হয়।

এরপর ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে চলছিল দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকাজ। তাও সব মামলার বিচার চলছিল না।

আইনজীবীদের দাবির প্রেক্ষিতে গত ৩০ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ৫ অগাস্ট থেকে নিম্ন আদালতের স্বাভাবিক বিচারকাজ শুরুর কথা জানানো হয়।

বুধবার আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরুর প্রথম দিন সকাল সাড়ে ১১ টায় ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতর বারান্দায় বিচার প্রার্থীদের বেশ ভিড় দেখা গেছে। তবে আদালত প্রাঙ্গনে আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।

আদালত ভবনের বারান্দায় লোকজনের মধ্যে শারীরিক দূরত্বও মেনে চলার দৃশ্য চোখে পড়েনি।

ঢাকার মহানগর দায়রা জজের এজলাসে অন্তত ২৫ জন আইনজীবীকে বসে থাকতে দেখা গেছে। তবে আইনজীবীদের হিয়ারিং ডায়াস বিচারকের আসন থেকে আগের চেয়ে খানিকটা দূরে স্থাপন করা হযেছে । এজলাসের প্রবেশমুখে পুলিশ সদস্যদেরকে দেখা গেছে থার্মাল স্ক্যানারে আইনজীবীদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে।

মহানগর দায়রা জজ, জেলা জজ, মুখ্য মহানগর হাকিম, মুখ্য বিচারিক হাকিমের এজলাসের ঢোকার পথে জীবানুনাশক ট্রে রাখা হলেও তাতে বালু ছাড়া ব্লিচিংয়ের অস্তিত্ব তেমন খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কার্যালয়ে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দেখা গেছে আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, মোহরারদের ভিড়। সিঁড়িতে কাউকে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতেও দেখা যায়নি।

বিষয়টি স্বীকার করে মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তাপস পাল বলেন, “আমি এবং এ আদালতের সংশ্লিষ্টরা অনেকবার চেষ্ট করেছি দোতলার এজলাস থেকে বিচারপ্রার্থীদের নীচে নামানোর জন্য । কিন্তু তাদের অনেক আইনজীবী বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে ভিড় করেন।”

অসহায়ত্ব শোনা গেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপ-কমিশনার জাফর হোসেনের কণ্ঠেও।

“আইনজীবীরা যদি বিষয়টি মেইনটেইন না করেন আমরা কী করতে পারি? আমরা খুব রিস্কের মধ্যে রয়েছি। আইনজীবী সমিতির এসবের দিকে লক্ষ্য রাখার কথা ছিল।”

একমাত্র মহানগর দায়রা জজ আদালত বাদে পুলিশের এ বিভাগের কার্যালয় এবং অন্য কোনো আদালতে, এজলাসের মুখে থারমাল স্ক্যানারের ব্যবহারও চোখে পড়েনি।

আদালতের বারান্দায় আইনজীবী, বিচারপ্রার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের কিছুটা জটলাও ছিল।

মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রসিকিউশন পুলিশের সাক্ষীর সেল কার্যালয়ে গিয়ে  দেখা গেছে রাষ্ট্রপক্ষে কোনো সাক্ষী হাজির হননি।

এ কার্যালয়ের দায়িত্বে থাকা এসআই মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “আজ কোনো সাক্ষীর তারিখ ছিল না বলে কেউ আসেননি। আস্তে-ধীরে তারিখ পড়বে। সাক্ষীর সমন অথবা অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যাবে সাক্ষীদের ঠিকানায়। তখন তাদের উপস্থিতি দেখা যাবে।

বিভিন্ন আদালত ঘুরে দেখা গেছে, অল্প সময়ের জন্য বিচারক এজলাসে বসেছেন, অনেকটা নিয়ম রক্ষার মতো।

সবচেয়ে ব্যস্ততম ঢাকার মহানগর দায়রা জজের এজলাসের বাইরে বারান্দায় হ্যান্ড মাইকে মামলা নম্বর এবং আসামির নাম ডাকার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এ আদালতের অধীনস্থ বিভিন্ন আদালতের পেশকারসহ কমচারীদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, কোনো মামলাতেই বুধবার সাক্ষীর তারিখ ছিল না।

ফৌজদারি মামলায় অভিজ্ঞ আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো বলেন, “এজলাসে বিচারক, তার বেঞ্চ সহকারী, অন্য কর্মচারী এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের দূরত্ব রেখে বসার ব্যবস্থা থাকলেও সাধারণ আইনজীবীদের জন্য সে ব্যবস্থা নেই। আদালতের বারান্দায়ও ভিড় থাকছে।সেক্ষেত্রে অবকাঠামোর দিকে নজর দিতে হবে। আদালতের বারান্দায় কোনো বিচারপ্রার্থীকে অনাবশ্যক অবস্থান করতে দেয়া যাবে না। তা না হলে বিপদ বাড়বে।

আইনজীবী জীবনানন্দ চন্দ জয়ন্ত বলেন, “টোটাল সিস্টেমের মধ্যে সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। নতুন ও সৃজনশীলভাবে অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। দেখছি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাও প্রতিপালিত হচ্ছে না। আদালতের বারান্দায় হাত ধোয়ার জন্য সাবান জল বা স্যানিটাইজেশন টিউব মেশিন থাকতে হবে, যেটি আমি কোনো আদালতে দেখছি না। এজলাসের বাইরে বারান্দা বা যেকোনো জায়গায় আইনজীবীদের অবস্থানের ব্যবস্থা থাকতে হবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে।

এজলাসে ঢোকার মুখে পরীক্ষা করা হয় শরীরের তাপমাত্রা।

এসব বিষয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যকরী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হোসেন আলী খান হাসানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আপনি তো বিষয়গুলো দেখেছেন। এসব বিষয়ে আমাকে দয়া করে জড়াবেন না। আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।”

এজলাসে হৈ চৈ

ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের ভার্চুয়াল শুনানিতে নামঞ্জুর করা জামিন আদেশের বিরুদ্ধে যেসব আইনজীবী সত্যায়িত কপি তুলে মহানগর দায়রা জজ আদালতে গেছেন তাদের শুনানি না নিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয় এদিন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইনজীবীদের সঙ্গে বিচারকের বাদানুবাদে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়।

বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশ বলেন, “যেহেতু সরাসরি শারীরিক উপস্থিতিতে শুনানি শুরু হয়েছে সেহেতু সবক্ষেত্রেই নিয়মিত স্বাভাবিক আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে এ আদালতে প্রতিকার চাইতে আসতে হবে। ভার্চুয়াল আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে আসলে সেটি শুনানির জন্য নেয়া হবে না।”

তার এ কথায় এজলাসে উপস্থিত আইনজীবীরা প্রতিবাদ করতে শুরু করেন।

বিচারকের এ সিদ্ধান্তে আইনজীবীরা উষ্মা প্রকাশ করে ন্যায়বিচারের প্রশ্ন তোলেন। তারা বলেন, ভার্চুয়াল আদালত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আইনসম্মতভাবে তৈরি হয়েছিল। সে আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে আবেদন গ্রহণ না করা একটি বেআইনি সিদ্ধান্ত।