যত্রতত্র কোরবানি, মানা হয়নি স্বাস্থ্যবিধি

কোরবানির জন্য সিটি করপোরেশন থেকে প্রতিটি ওয়ার্ডে স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও সেখানে তেমন পশু জবাই হয়নি, অধিকাংশই বাড়ির আঙিনায় বা সামনের সড়কে দিয়েছেন কোরবানি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2020, 12:01 PM
Updated : 1 August 2020, 12:01 PM

আবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে মুখে মাস্ক পরে ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কোরবানির কার্যক্রম সারতে বলা হলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা দেখিয়েছেন বহু মানুষ।

শনিবার রাজধানীর পুরান ঢাকার নবাবপুর রোড, রায়সাহেব বাজার মোড়, তাঁতীবাজার, বংশাল, নিমতলী, হাজারীবাগের মনেশ্বর রোড, ধানমন্ডি সেন্ট্রাল রোড, বাংলামোটর, ইস্কাটন, মৌচাক, খিলগাঁও, গোড়ান, বনশ্রী, বনানী বাজার, ভাটারার ছোলমাঈদ, সাঈদনগর এলাকাগুলো ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।

সকাল ৮টার দিকে নবাবপুর রোডে কোরবানিতে শরিক অধিকাংশের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। ন্যূনতম শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধান থাকলেও অনেকেই তা মানতে চাননি।

এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল খালেককে প্রশ্ন করলেন তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই একটা প্রশ্ন করলেন! কোরবানির দিনে মাস্ক-মুস্ক পইরা কি কোরবানি দিওন যায়? আল্লাহর নামে কোরবানি দিতেসি। কিছু হইব না আমাদের।”

এই জায়গায়ই কোরবানি দেওয়ার জন্য গরু নিয়ে অপেক্ষায় থাকা কয়েকজন মাস্ক পরে ছিলেন। তারা একটু দূরে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।

তাদের একজন বলেন, “করোনাভাইরাসের ভয়টা সবার মধ্যে নেই। এটা তো জোরাজুরির কোনো বিষয় না। কে মানবে, কে মানবে না- সেটা একেবারে ভিন্ন বিষয়। আমি আমার সুরক্ষার জন্য মাস্ক পরে আসছি। স্যানিটাইজারও সাথে এনেছি।”

সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থানে কোরবানি না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে রায়সাহেব বাজারের ইংলিশ রোডের বাসিন্দা এনামুল হাবিব বলেন, “যতটা সম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থেকেই কোরবানি দিচ্ছি। সিটি করপোরেশন জায়গা ঠিক করে দিয়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু সেখানে কোরবানি দেওয়ার মতো পরিবেশ নাই। আমাদের যেতে ইচ্ছা করে না।” 

রায়সাহেব বাজার মোড় থেকে বংশাল আসতে ইংলিশ রোড ও নর্থ সাউথ রোডের দুই পাশেই কোরবানি দিতে দেখা গেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। কোরবানির পর নিজেরাই বর্জ্য অপসারণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা।

আলুবাজারের বাসিন্দা ফারুক আহমেদ বলেন, “আমাদের বাড়ির সামনে কোরবানির জায়গা নেই। কী করব আর, প্রধান সড়কেই দিতে বাধ্য হচ্ছি। তবে কোরবানির রক্ত ছাড়া আর কোনো বর্জ্য যেন ড্রেনে গিয়ে না পড়ে, সেদিকে আমরা লক্ষ রাখছি।”

কোরবানির জন্য স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া থাকলেও সড়কের ওপরেই পশু জবাই করতে দেখা যায় পুরান ঢাকার বংশালে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

হাজারীবাগের মনেশ্বর রোড ও ধানমন্ডি সেন্ট্রাল রোডেও কোরবানিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখা যায়নি। মনেশ্বর রোড ছাড়াও আশপাশের অলিগলিতে কোরবানি দেওয়ার সময় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে চাননি তারা।

মনেশ্বর রোডের বাসিন্দা তামান্না রহমান স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনা করে একটি ফার্মকে কোরবানির যাবতীয় দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন। তবে তার প্রতিবেশীরা সেদিকে আগ্রহ দেখাননি।

তামান্না বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার বাসার নিচে প্রায় ১০-১২টা গরু কোরবানি হয়েছে। কারও মুখে আমি মাস্ক দেখিনি। এদের মধ্যে ভয়ডর কিছু নেই। সচেতনতার নির্দেশনা থাকলেও এরা মানতে নারাজ। আমি দুজন প্রতিবেশীকে বলেছিলাম কোনো একটা ফার্মকে দায়িত্ব দিতে। তাদের উত্তরটা আর ভালো লাগে নাই।”

সেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা গবেষক ইকবাল খন্দকার বলেন, “নামাজ পড়ে আসতে গিয়ে দেখি, বাড়ির সামনে বর্জ্যের স্তূপ জমে আছে। জানি না, কতক্ষণ পরে এসে সিটি করপোরেশন এই বর্জ্য সরাবে। দুর্গন্ধে ঘরের জানালাও খুলতে পারছি না।”

আনসার ক্যাম্প পেরিয়ে খিলগাঁওয়ের সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের দিকে এগোতে মালিবাগ-মুগদা বিশ্বরোডের পাশেই কোরবানি দিতে দেখা গেল একটি দলকে। মুখে মাস্ক থাকলেও শারীরিক দূরত্ব ছিল না তাদের মধ্যে।

খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ার বাসিন্দা স্বপন মিয়া বলেন, “যাদের কোরবানি দেওয়ার মতো জায়গা নাই, তারা আর কী করবে? সিটি করপোরেশনের জায়গায় কোরবানি দিতে গেলে সারা শহরবাসীর তিন দিন লাগব। ওখানে না আছে ইমাম, না কসাই, না আছে ভালো ব্যবস্থা। একবার গেছিলাম কোরবানি দিতে, বিরক্ত হইসি খুব।”

রাজধানীর উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের নূরেরচালা বাজার মসজিদের পূর্ব পাশের খোলা জায়গায় কোরবানির স্থান নির্ধারিত হলেও বেলা ১১টার দিকে সেখানে গিয়ে পশু কোরবানির কোনো আয়োজন দেখা যায়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা ইসমাইল হোসেনকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিজের বাড়ির সামনে জায়গা থাকলে কে আইব এতদূর? গরু টাইনা আনা, এখানে আইনা সিরিয়ালে অপেক্ষায় থাকা, কে বা এত যন্ত্রণা সইব? তার চেয়ে নিজের বাড়ির সামনে জায়গা পাইলে কোরবানি দিলাম।”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন বলেন, “কোরবানির জন্য স্থান নির্ধারণ করে দেওয়ার বিষয়টি খুব বেশি দিন আগে চালু হয়নি। নগরবাসী এখনও অভ্যস্ত হননি। কিছু দিন সময় তো লাগবেই।

“তবে আমি মোহাম্মদপুর, শ্যামলী এলাকাগুলো ঘুরে দেখেছি, নগরবাসী নিজ উদ্যোগে বর্জ্য অপসারণ করছেন। কিছু কিছু এলাকায় বর্জ্য পড়ে থাকার খবর পেয়েছি। আমাদের টিম দ্রুত সেই বর্জ্য অপসারণে কাজ করছে।”

আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-১ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, “নগরে প্রতিটা ওয়ার্ডে একটা স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া ছিল কোরবানির জন্য। কিন্তু আমরা নগরবাসীর পক্ষ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাইনি। নগরবাসী সেই পুরনো ধারাতে নিজ বাড়ির সামনে, সড়কেই কোরবানি দিয়েছেন।

“আমাদের কাজটা একটু কঠিন হল। তবে সকাল ১১টা থেকে কর্মীরা মাঠে রয়েছেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বর্জ্য অপসারণ করা হবে বলে মেয়র মহোদয় যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নে কাজ করছি আমরা।”

নগরে কতটি গরু কোরবানি হয়েছে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম মনিটরিং কন্ট্রোল রুমে দায়িত্বরত কর্মকর্তা অতুল কুমার বিশ্বাস বলেন, “এই সংখ্যা এখনও আমাদের কর্মীরা জানতে পারেননি। দুপুরের বৃষ্টিতে কাজে একটু ব্যাঘ্যাত ঘটেছে। নগরবাসী নির্ধারিত স্থানে কোরবানি দিতে চাননি। কী করা যাবে? সিটি করপোরেশন দ্রুততম সময়ের মধ্যে কোরবানির বর্জ্য অপসারণে কাজ করবে।”