দুঃসময়ের আঁধার কাটার প্রত্যাশার ঈদ

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যার বিস্তার; প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত জাতীয় জীবন, সেই সময় এলো আনন্দের উপলক্ষ ঈদুল আজহা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2020, 06:10 PM
Updated : 1 August 2020, 02:37 AM

মহামারীর এই দুঃসময়ে ঈদুল আজহা যেন সব আঁধার সরিয়ে মানুষের মধ্যে অনাবিল আনন্দ নিয়ে আসে সেই প্রত্যাশা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবাইকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে ঈদ উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

সারা বিশ্বকে আতঙ্কিত ও স্থবির করে দেওয়া করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেই মাস দুয়েক আগে এসেছিল মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। ভাইরাস আতঙ্কের সেই সময়ের ঘরবন্দি দশা ঘুচলেও এখনও প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন বহু মানুষ।

এই সঙ্কটের দিনেও ঈদ ঘিরে উজ্জীবিত হওয়ার চেষ্টা করছে মানুষ, সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের আশায় সামর্থ্যবান অনেকে কোরবানির জন্য পশু কিনেছেন।

ঢাকার হাটগুলোতে গরুর দাম কম ওঠায় শুরুতে ক্রেতারা খুশি ছিলেন, বিক্রেতাদের মধ্যে ছিল হাহাকার। তবে শেষ দিনে অনেক হাটে গরুর সঙ্কট দেখা যায়, দাম বাড়ায় বিক্রেতারাও ছিলেন খুশি।  

ঈদের আগের দিন শুক্রবার কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর হাটে ক্রেতাদের বেশ ভিড় ছিল, তবে গরু ছিল সেই তুলনায় কম। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এই মহামারীতে সরকারি-বেসরকারি সব চাকরিজীবীকে যারা যার কর্মস্থলের এলাকায় ঈদ করতে বলেছে সরকার। তারপরও সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাড়ির পথ ধরেছেন অনেকে।

পদ্মায় তীব্র স্রোতে পারাপার ব্যাহত হওয়ায় ঈদের আগের দিন শুক্রবার শিমুলিয়ায় ছিল ব্যাপক ভিড়, পাটুরিয়ায় ছিল দীর্ঘ জট। ঢাকা থেকে উত্তরের পথে টাঙ্গাইল মহাসড়কের থেমে থেমে যানজট চলে সারাদিন।

শনিবার ঈদুল আজহার সকালে জাতীয় ঈদগাহে কোনো ঈদ জামাত হচ্ছে না। রোজার ঈদের মতই খোলা ময়দান বাদ দিয়ে সারা দেশে মসজিদে মসজিদে ঈদ জামাতের আয়োজন হয়েছে।

জামাতে একসঙ্গে নামাজ আদায়ের সুযোগ হলেও কোলাকুলি করা যাচ্ছে না, হাত মেলানোও বন্ধ। করোনাভাইরাস অতি ছোঁয়াচে বলেই এ ব্যবস্থা।

সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলা হয়েছে, সব ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে ঈদের নামাজ আদায় করতে হবে।

ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীসহ বিশ্বের মুসলমানদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, “এ বছর এমন একটা সময়ে ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন মহামারী করোনার ছোবলে বিশ্ববাসী বিপর্য‌স্ত। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অনেক মানুষই মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব মানুষের কল্যাণে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সকলকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

“করোনা মোকাবেলায় সকলকে সচেতন হতে হবে এবং জীবনযাপনে ও চলাফেরায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। নিজে সুস্থ থাকি, অন্যকেও সুস্থ রাখি- এটাই হোক এবারের ঈদুল আজহায় সকলের অঙ্গীকার।”

সবাইকে সরকার নির্ধারিত স্থানে পশু কোরবানি দিতে এবং কোরবানির বর্জ্য অপসারণসহ সব কাজে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপ্রধান।

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার বিকালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভিডিওবার্তায় দেশবাসীকে ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, “প্রিয় দেশবাসী, আসসালামু আলাইকুম। বছর ঘুরে আমাদের মাঝে আবার এসেছে পবিত্র ঈদুল আজহা। করোনাভাইরাস মহামারীর এই দুঃসময়ে সকল আঁধার কাটিয়ে ঈদুল আজহা আমাদের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ।

“আসুন কোরবানির ত্যাগের মহীমায় উজ্জীবিত হয়ে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করি। দেশ ও দেশের বাইরে অবস্থানরত সকল বাংলাদেশি ভাইবোনকে পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।”

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন, ঈদ মোবারক।”

শিমুলিয়ায় ঘরমুখো মানুষের ভিড়

পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এবার আমরা এক সঙ্কটময় সময়ে ঈদুল আজহা উদ্যাপন করছি। করোনাভাইরাস সমগ্র বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। আমাদের সরকার এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা জনগণেকে সকল সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি।

“আল্লাহ বিপদে মানুষের ধৈর্য্য পরীক্ষা করেন। এসময় সকলকে অসীম ধৈর্য্য নিয়ে সহনশীল ও সহানুভূতিশীল মনে একে অপরকে সাহায্য করে যেতে হবে।”

এই বিপদের সময় স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, ব্যাংকার ও পরিচ্ছন্নতাকামীসহ যারা জীবন বাজি রেখে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন, তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান সরকারপ্রধান।

প্রতি বছর ঈদ সামনে রেখে রাজধানী ঢাকা থেকে লাখ লাখ মানুষের যে ঈদযাত্রা হয় এবার সেভাবে হয়নি। করোনাভাইরাস সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ায় একটি বিশাল জনগোষ্ঠী এবার বাড়ি না গিয়ে ঢাকায় ঈদ করছেন।

মহামারী মানুষে মানুষে যে দূরত্ব তৈরি করেছে তাতে ঈদে আগের মতো আনন্দ পাচ্ছেন না মালিবাগের আবু জর গিফারী কলেজের স্নাতক বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শফিকুল ইসলাম রিজভী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখন দেখবেন ঈদের রীতিনীতিও পাল্টে গেছে। ঈদের যে সামাজিকতা আছে, সেটাও নাই। মানুষ আত্মীয়-স্বজনকে দেখতে বাড়ি যায়, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বাসায় যায়- এবার সেটা নেই। উল্টো ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সব কিছুর কারণ করোনা।”

এদিকে ভাইরাসের বিস্তার রোধে টানা দুই মাসের লকডাউনে আয়-উপার্জনে টান পড়ে বেকায়দায় আছে বহু মানুষ। ঈদে গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সাধ্যে কুলায়নি তাদের। 

মালিবাগ রেল গেইটের বস্তির বাসিন্দা মনোহারা বেগম

এদেরই একজন ঢাকার মালিবাগ রেল গেইটের বস্তির বাসিন্দা মনোহারা বেগম; তার কাছে ঈদ মানে দুধ-সেমাই খাওয়া আর পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া।

মনোয়ারার গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর ডিমলার টুনিরহটে। এবার বাড়ি যাওয়া হয়নি তার, বরং করোনাভাইরাসের কারণে হাতে পয়সা-কড়ি না থাকায় দুশ্চিন্তায় আছেন সামনের দিনগুলো নিয়ে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আঙগো কিসের ঈদ, আঙগো কোনো ঈদ নাই। হাতে পয়সা-কড়ি নাই, কেমনে ঈদ করমু, ঈদ আঙগো ভাগ্যে নাই।”

৬২ বছর বয়সী মনোয়ারা রেল লাইনের পাশে চিতই পিঠা বিক্রি করে ৪০-৪৫ টাকা উপার্জন করেন। রেললাইনের পাশেই বস্তিতে থাকেন। দুই ছেলে-দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার। ক্রেতা না থাকায় এখন তার মুখ ভার।

শুক্রবার বিকালে ওই বস্তির সামনের রেললাইনে খেলা করছিল দুই শিশু রিপন ও সুলতান। তাদের কাছে ঈদ হল নতুন জামা আসার দিন। রিকশাচালক বাবা এবার তাদের জন্য নতুন জামা আনেননি।

রিপন বলে, “কাইল (আগামীকাল) কোরবানির ‍গরু জবাই হইব- এইটা জানি। ঈদ যে জানি না। নতুন জামা তো পাই ন।”

ভাঙ্গনের কবলে পড়ে পদ্মায় বিলীন হওয়ার পথে শরীয়তপুরের বসাকেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আরেকটি ভবন। এর আগে বুধবার দুপুরে এই বিদ্যালয়ের একটি একতলা ভবন পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়।

রাজধানীর স্বল্প আয়ের ও ছিন্নমূল মানুষের মতই ঈদ এবার বিশেষ কোনো আনন্দের উপলক্ষ্য হয়ে আসেনি বন্যা কবলিত ৩১টি জেলার লাখ লাখ মানুষের কাছে।

পানির তোড়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে তাদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন স্কুল ঘরে বা বাঁধে। তিন বেলা ভাত পাওয়াই তাদের অনেকের জন্য বড় চিন্তা। এদিকে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার নদী ভাঙনে সর্বস্বান্ত হচ্ছে বহু পরিবার।

বন্যা কবলিত নীলফামারীর ডিমলার কৃষক আবুল মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাই ভেইন বেলা থেইকা বৃষ্টি, পানি বাড়ছে। খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। ঘরের দুয়ারে পানি ছুঁইছুঁই করতেছে। পুকুর-টুকুর, ফসলের ক্ষেত সব ডুবে গেছে বন্যার পানিতে। কী যে হইব!”

আবহাওয়া ভালো থাকলে এমনিতে দেশে ঈদের প্রধান জামাতটি হয় ঢাকায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সেই জামাতে নামাজ পড়েন ঈদের সকালে। এবার তা হয়নি না।

রাজধানীতে ঈদের প্রধান জামাত হয় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে সকাল ৭টায়। এরপর সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে, ৮টা ৪৫ মিনিটে, ৯টা ৩৫ মিনিটে, ১০টা ৩০ মিনিটে এবং ১১টা ১০ মিনিটে ধারাবাহিকভাবে পরের পাঁচটি জামাত হবে বলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানিয়েছে। 

এবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সকাল সাড়ে ৮টায় বঙ্গভবনের দরবার হলে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করবেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে সেখানেই নামাজ পড়বেন রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্য ও বঙ্গভবনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। রোজার ঈদের মত এবারও বঙ্গভবনে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠিত হবে না।

প্রতিবছর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাতের আয়োজন হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয় খোলা মাঠে ঈদ জামাত আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় শোলাকিয়া ময়দানে রোজার ঈদের মতো এবারও ঈদ জামাত হচ্ছে না।

ঢাকায় সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় এবার ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঈদ জামাতের আয়োজন থাকছে না। মসজিদগুলো নিজেদের ব্যবস্থাপনায় ঈদ জামাতের আয়োজন করছে।

ঈদের জামাতের সময়ে মসজিদে কার্পেট বিছানো যাবে না, নামাজের আগে সম্পূর্ণ মসজিদ জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।

অজু করার সময় কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুতে বলা হচ্ছে সবাইকে। মসজিদে অজুর স্থানেও সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে বলা হয়েছে।

শনিবার রাজধানীসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় হালকা বৃষ্টি হতে পারে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।