পানি কমার আশার সঙ্গে তীব্র ভাঙনের শঙ্কা

পদ্মার প্রবল স্রোতে জাজিরার মঙ্গলমাঝির ঘাটের পূর্বপাশের চারটি ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে দেখা দিয়েছে ভাঙন। প্রায় চারশ পরিবারকে ঘর সরিয়ে নিতে হয়েছে।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 July 2020, 05:42 PM
Updated : 28 July 2020, 03:55 AM

উপজেলার বড়কান্দি, পালের চর, কুন্ডেরচর ও বিলাশপুর ইউনিয়ন এবং মঙ্গলমাঝির ঘাট সংলগ্ন ওকিলউদ্দিন মুন্সিকান্দি, আলমখার কান্দি, চেয়ার আলী কান্দি, ছৈয়াল কান্দি ও পৈলান মোল্যা কান্দি গ্রামে গত কয়েকদিন ধরে চলছে এই ভাঙন।

দেশে বন্যার দুর্ভোগের মধ্যে নদী ভাঙনে মানুষের সর্বস্ব হারানোর খবর আসছে বিভিন্ন স্থান থেকেই।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সোমবারই জানিয়েছে, অগাস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধান নদীগুলোর পানি কমতে পারে। যা বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

এর মধ্যেই সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস) থেকে জানা গেল, অগাস্টের শুরুতেই নদী ভাঙন তীব্র রূপ নিতে পারে।

কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ি, পাবনা, মাদারীপুর, ফরিদপুর জেলার অন্তত ২৮ উপজেলার নিম্নাঞ্চলে নদী ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

যেসব স্থানে এবার ভাঙন তীব্র হতে পারে।

সিইজিআইএস’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভাঙন বাড়ছে বেশি পানি নেমে যাওয়ার সময়। এবার স্বাভাবিকের চেয়ে বড় বন্যা হচ্ছে। প্রধান তিন নদী অববাহিকায়ই ভাঙন তীব্রতর হতে পারে।

“সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার হেক্টরেরও বেশি ভূমি ভাঙনের মুখে পড়ার শঙ্কা রয়েছে এ বছর।”

তাই আগাম জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন দেখছেন আবদুল্লাহ খান।

“এখনই জরুরিভিত্তিক ব্যবস্থা নিতে হবে ভাঙন রোধে। রক্ষা, পুনরুদ্ধার ও ভাঙন রোধে নদীর জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তো করতেই হবে।”

গত ২৬ জুন থেকে শুরু হওয়ার এবারের বন্যায় দেশের প্রায় ৩১% এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অর্ধ কোটি মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। পানিতে ডুবে, সাপে কেটে ও নানাভাবে মারা গেছে শতাধিক মানুষ। এরইমধ্যে, কৃষিজ, অবকাঠামোগত ও নানা ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ।

এবারের বন্যা পর্যবেক্ষণ করছে সিইজিআইএস।

ফিদা আবদুল্লাহ খান বলেন, গত বছরের বন্যাটা ছিল সাধারণ বন্যা।

“এবারের বন্যাটা প্রথম দুই বছর পর পর আসে সে রকম বন্যা নয়। তার চেয়ে আরেকটু বড় মাপের বন্যা। বড় বন্যায় নদীর পানি প্রবাহ বেড়ে যায়। পানি প্রবাহ বেশি থাকার কারণে এবারে ভাঙনও বেশি হবে। এজন্য আমরা মনে করছি, ভাঙনটা এবার অনেক বেশি হবে।”

মাদারীপুরে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে এই স্কুল

ইতোমধ্যে দেশের বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চলে এক মাস ধরে প্লাবিত রয়েছে।

এ প্রসঙ্গ টেনে আবদুল্লাহ খান বলেন, তিন অববাহিকার ভাটি অঞ্চল বাংলাদেশে বড় বন্যা ৫০/১০০ বছর পর হয়। আবার ৮-১০ বছর পরও দেখা দেয়। ১৯৯৮-৮৮ এর বন্যা ৫০ বছর পর পেয়েছিল বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত যেটুকু হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে ১০ বছরে একবার হয় এরকম বন্যার ধরন এবারেরটা।

“ব্রহ্মপুত্র অববাহিককায় বন্যা বেশি হচ্ছে। এখনও এর ভয়াবহতা ১৯৮৮ কিংবা ১৯৯৮ এর বলা যাবে না। তবে আমরা বিভিন্ন ডেটা এনালাইসিস করে দেখেছি, এখনও ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা অববাহিকায় বৃষ্টির আধিক্যটা রয়েছে।”

কখন ‘পিক টাইম’

সিইজিআইএস’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ খান বলেন, “আমাদের সাধারণত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যাটা হয় দুটো সময়ে। জুলাই ও সেপ্টেম্বরে পিকটা আসে। গঙ্গায় আসে অগাস্টে ও সেপ্টেম্বরে।”

তিনি বলেন, “আমরা ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের সঙ্গে যদি তুলনা করি, তাহলে বন্যার দুটো ‘পিক’ একসঙ্গে এসেছে। এবার বন্যাটা বেশি হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায়। গঙ্গা অববাহিকায় শুরু হচ্ছে, কিন্তু দেরিতে।

“পুরোপুরি বন্যার প্রবাহ দেশে এখনও আসেনি। ২৬- ৩০ জুলাই ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় সাতশ থেকে সাড়ে সাতশ মিলিমিটার টোটাল বৃষ্টি হবে। গঙ্গা অববাহিকায় ৫০০- ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে আগামী চার দিনে। এখনও কম।

তিস্তা নদীর প্রবল স্রোতে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বুড়িরহাট স্পারের ৫০ মিটার বিলীন হয়েছে

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য আবদুল্লাহ খান বলেন, “অগাস্টের শেষে বা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে আবার এ দুই বেসিনে খুব বেশি বৃষ্টি হয়, তাহলে আরেকটা ফ্লাড ওয়েব আসতে পারে।

“বৃষ্টিতে উজানে পানি বাড়ার সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে করতেই ‘রাইজিংটা’ অনেক কমে যায়। আমি বলব, ওই ধরনের বন্যার মতো এখনই চিন্তা করাটা সময় আসেনি। তবে আমাদের সচেতন থাকতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে।”

অগাস্টের শুরুতে পানি কমবে: পাউবো

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পুর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, উজানে বৃষ্টি কমায় নদ-নদীর পানি প্রবাহ ধীর হওয়ায় বিরাজমান বন্যা পরিস্থিতি অগাস্টের প্রথমার্ধে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভুইয়া বলেন, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি এখনও বাড়ছে। বিপদসীমার উপরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ ও উজানে মৌসুমী বায়ু একটু স্বাভাবিক অবস্থায় আসায় ভারি বর্ষণের প্রবণতা কমে এসেছে। তবে চলতি সপ্তাহে অনেক স্থানে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে।

মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার চরাঞ্চল ব্রাহ্মণগাঁও এখন বানের পানিতে নিমজ্জিত।

এ কর্মকর্তা জানান, পানি কমার প্রবণতা কিছুটা ধীর হয়ে আসায় চলতি সপ্তাহে নদ-নদীর পানি স্থিতিশীল থাকতে পারে।

“ফলে অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে পানি কমতে পারে ও দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশের বন্যাকবলিত অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।”

বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের পূর্বাভাস বলছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ি, শরীয়তপুর, ঢাকা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশিীল থাকতে পারে।

নদীগুলোতে পাউবোর ১০১টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় পানি কমেছে ৬৪টি পয়েন্টে, বেড়েছে ৩৭টি পয়েন্টে। ২০টি নদীর ৩০টি স্টেশনে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে।

ভাঙন তীব্র হবে অগাস্টের শুরুতে

বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় এবার ব্যাপক নদী ভাঙন হবে বলে মনে করছেন সিইজিআইএস’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ খান।

তিনি বলেন, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ২৯ জুলাই থেকে পানি কমবে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে নদীর ভাঙনটাও হবে। ২৯ জুলাই পর্যন্ত গঙ্গায় পানি বাড়বে। হয়ত পদ্মায় পানির পরিমাণটা বাড়বে; দুই পাড়ের নিম্নাঞ্চল কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুরের কিছু নিম্নাঞ্চল আরেকটু প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আবদুল্লাহ খান বলেন, “তারপর অগাস্টের প্রথম দিকে পানি নামা শুরু করবে। সঙ্গে সঙ্গে ভাঙনের পরিমাণটা বেড়ে যাবে। যমুনা, পদ্মার যেসব জায়গায় ভাঙনের সম্ভাবনা রয়েছে, তা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।

“প্রটেকশনের জন্য এটাই বলে আসছি আমরা। নদী ভাঙন যেন কম হয়, সম্ভাব্য জায়গায় ইমার্জেন্সি বেসিসে জিও ব্যাগ, ব্লক ডাম্পিং করতে হবে। বাঁধগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।”

টাঙ্গাইলে পুংলী নদীর ভাঙন ঠেকাতে ফেলা হচ্ছে জিও ব্যাগ

এক যুগ আগে বড় তিনটি নদীতে প্রতি বছর ১০ হাজার হেক্টর করে ছিল নদী ভাঙনের পরিমাণ। তাতে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার পরিবার ভূমিহীন হয়ে পড়ে। স্থানচ্যুত হতে হয় তাদের। নানা ধরনের প্রযুক্তি ও অবকাঠামোর কারণে এখন তুলনামুলক ভাঙন কমেছে।

আবদুল্লাহ খান বলেন, “এখন প্রতিবছর সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে ভাঙন। এবার তার চেয়ে বেশি হতে পারে। সাড়ে ৩ হাজার-৪ হাজার হেক্টরের চেয়ে বেশি ভাঙনের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে।”

ভাঙন এড়াতে নদীকে নির্দিষ্ট গতিপথে রেখে নদীর ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা, পাশাপাশি নদী পুনরুদ্ধার করা, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অনুযায়ী ডেল্টা প্ল্যান অনুসরণে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন সিইজিআইএস’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক।