গরুর দাম শুনেই সরছেন ক্রেতারা

মহামারীর মধ্যে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে গ্রামের হাটগুলোতে ব্যাপারীরা গরুর দাম ‘অনেক কম’ বললেও তারাই আবার ঢাকায় গরু এনে চড়া দাম হাঁকছেন; ফলে এখনও ততোটা জমে না ওঠা ঢাকার হাটগুলোতে গরুর দাম শুনেই সরে যাচ্ছেন ক্রেতারা।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2020, 06:14 PM
Updated : 25 July 2020, 08:33 PM

শনিবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি কোরবানির পশুর হাট ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। ব্যাপারীদের চড়া দাম হাঁকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন হাটগুলোর ইজারাদাররাও।

উত্তরখান মৈনারটেক হাউজিং প্রকল্প মাঠের ইজারাদার পারভেজ মিয়া, উত্তরার ১৭ নম্বর সেক্টরের বৃন্দাবন হাটের ইজারাদার মো. নূর হোসেন, কাওলা শিয়ালডাঙ্গার ইজারাদার রুবেল শওকত, ডুমনি হাটের ইজারাদার মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া এই হাটগুলোতে কোরবানির পশু আসতে শুরু করলেও ক্রেতা একেবারেই হাতেগোনা। যারা আসছেন তারাও দাম শুনেই চলে যাচ্ছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আফতাবনগর হাটে তুলনামূলকভাবে বেশি গরু এলেও ক্রেতার পদচারণা এখনও অনেক কম।

আফতাবনগর হাটে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে আসা রমিজ উদ্দিন ব্যাপারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তিনি দেশি জাতের ছয়টি গরু নিয়ে এসেছেন। ৬ থেকে ৮ দাঁতের এসব গরুর প্রতিটিতে সাত থেকে আট মণ মাংস হবে। আকৃতিভেদে এসব গরুর দাম দেড় থেকে দুই লাখ টাকা চাইছেন তিনি।

ক্রেতা নিয়ে রমিজ বলেন, “ক্রেতা আসছে। দাম জিজ্ঞাসা করে আবার চলে যাচ্ছে। গরু কেনাতে কারও মধ্যে আগ্রহ দেখি নাই।”

ঝিনাইদহ থেকে হরিয়ানা, ফিজিয়ান জাতের আটটি গরু নিয়ে এসেছেন সোলেমান শেখ। আকৃতিভেদে তিনি এসব গরুর দাম হাঁকছেন দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। 

পোস্তগোলা শ্মশানঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে সদরঘাটে যাওয়ার সড়কটিতেও রাখা হচ্ছে পশু। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

সোলেমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবেমাত্র হাট শুরু হল। আশা করি, আরও দুই-তিন দিন পর ক্রেতারা আসতে শুরু করবেন।”

মেরুল বাড্ডা থেকে এই হাটে আসা ক্রেতা ইশতিয়াক মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে যে দাম চাওয়া হচ্ছে, তা তুলনামূলকভাবে বেশি। যে গরুর দাম হতে পারত সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা, সেই গরুর দাম বলছে দেড় লাখ টাকা। গরুর এত দাম হবে চিন্তাও করি নাই।”

রামপুরার বাগিচারটেক থেকে আসা ক্রেতা সাদেক হোসেন বলেন, “গরুর যা দাম! এই দেখে কেনার আশা আর নাই। অনলাইনে গরু কিনতে চাইনি। ভরসা পাচ্ছিলাম না। তাই হাটে আসা। কিন্তু গরুর এত দাম হলে কিনব কেমন করে?”

গরুর দাম নিয়ে ঢাকার এই ক্রেতারা বিস্ময় প্রকাশ করলেও পুরো ভিন্ন চিত্র বাইরের জেলাগুলোতে। বিভিন্ন জেলা থেকে কোরবানির পশুর হাটে ক্রেতা না থাকার খবর আসছে। মূলত ব্যাপারীরাই ওই সব হাট থেকে গরু কিনে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে এনে বিক্রি করেন।

ঈদের মাত্র আর এক সপ্তাহ বাকি থাকলেও গ্রামের হাটগুলোতে এখনও ব্যাপারীরা গরু কেনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে কয়েক হাট ঘুরে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম দামে গরু ছেড়ে দিচ্ছেন অনেক গৃহস্থ।

বৃহস্পতিবার খুলনার তেরখাদার ইখড়ি হাটে ৬০ হাজার টাকায় একটি গরু বিক্রি করে আসা নড়াইলের কালিয়ার বুলবুল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঈদের বাজার শুরু হওয়ার আগে ব্যাপারীরা এই গরুর দাম বলেছিল ৭০ হাজার টাকা। দাম আরও বেশি হবে মনে করে সে সময় দিইনি।

“এরপর গত রোববার পাশের গ্রামের একটি হাটে গরু নিয়ে যাই। সেখানে তেমন কেউ আগ্রহ দেখায়নি। কালকে ইখড়ি হাটে নেওয়ার পরও কেউ দাম বলছিল না। যখন চলে আসব তার আগে একজন ৬০ হাজার টাকা দাম বলায় দিয়ে দিয়েছি। গরু নিয়ে আর কত ঘুরব? হাটও তো বেশি নেই।”

ঢাকায় গরুর চড়া দাম হাঁকা নিয়ে অসন্তোষ জানালেন ভাটারার সাঈদনগর গরুর হাটের ইজারাদার সিদ্দিকুর রহমানও।

পোস্তগোলা শ্মশানঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে সদরঘাটে যাওয়ার সড়কটিতেও রাখা হচ্ছে পশু। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার গরুর দাম একটু বেশি চাওয়া হচ্ছে। যে গরুর দাম এক লাখ টাকা সেটা দেড় লাখ আর দেড় লাখ টাকার গরুর দাম চাইছে দুই লাখ টাকা। ক্রেতারা দাম জিজ্ঞাসা করে চলে যাচ্ছেন।”

ঢাকার উত্তরখান মৈনারটেক হাউজিং প্রকল্প মাঠের ইজারাদার পারভেজ মিয়া জানান, তাদের হাটে ৫০ থেকে ৬০টি গরু এলেও ক্রেতা নেই।

তিনি বলেন, “আমাদের হাটটা একটু ভেতরের দিকে হওয়াতে এমনিতেই বিপদে আছি। ক্রেতারা অনেকে জানে না এখানে একটা হাট আছে। আমরা তো আর আবদুল্লাহপুর থেকে গিয়ে গরুর ট্রাক ধরে আনতে পারব না। তারপরও এ হাটে যে গরু আসছে, তার ক্রেতা নাই।”

আগামী ২৮ জুলাই থেকে ক্রেতা-বিক্রেতাদের দরদাম হাকাহাকিতে তাদের হাট জমে উঠবে বলে আশা করছেন পারভেজ।

উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরের বৃন্দাবন হাটের ইজারাদার মো. নূর হোসেন জানান, গত শুক্রবার থেকে হাটে গরু নিয়ে আসতে শুরু করেছেন ব্যাপারীরা।

তিনি বলেন, “আকৃতিভেদে গরুর দাম হাঁকছে ৬০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। গরুর পাশাপাশি ভেড়া ও খাসিও আসতে শুরু করেছে হাটে। এখনও বিক্রি শুরু হয়নি।”

করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের মাস্ক পরার কথা থাকলেও অনেকেই তা পরছেন না। এ বিষয়টি তদারক করার কথা সিটি করপোরেশনের। তবে সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকে বুথে পাওয়া যায়নি। 

কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য শনিবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নৌকায় করে গরু আনা হয় ঢাকার পোস্তগোলা শ্মশানঘাট পশুর হাটে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

হাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাস্ক পরা, বিভিন্ন বুথে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও সাবান থাকার কথা থাকলেও সেদিকে কর্তৃপক্ষের ‘নজর নেই’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন রায়হান কবির নামে একজন ক্রেতা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাটে এসে তো মহাবিপদে পড়েছি। সেখানে দেখলাম না কোনো স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে।”

তবে ইজারাদার নূর হোসেন বলেন, “রোববারের মধ্যেই স্বেচ্ছাসেবকরা হাটের বুথগুলোতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান যেন থাকে তা নিশ্চিৎ করবেন।”

কাওলা শিয়ালডাঙ্গা হাটের ইজারাদার রুবেল শওকত জানান, তাদের হাট আগামী ২৮ জুলাই থেকে শুরু হবে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম আগেই জানিয়েছেন, এবার ১২০০ মেডিকেল টিম বসিয়ে কোরবানির পশুর হাটে আসা প্রাণিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে।

নূর হোসেন জানান, তাদের হাটে ছয়টি বুথ বসিয়ে পশু চিকিৎসকরা পশু পরীক্ষা করে তবেই হাটে ঢুকতে দিচ্ছেন।

এবার কোরবানির হাটে যেন কোনো বিদেশি পশু আসতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মেডিকেল টিম।

এ বিষয়ে মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বন্যার পানিতে টুকটাক যে গরু একেবারে আসছে না একথা বলব না। তবে অন্যান্য বছর গরু বা অন্যান্য পশু আসার ক্ষেত্রে যে উদারতা দেখা যায় তা এবার করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি, সীমান্তপথে বিজিবি যেন কঠোরভাবে নজরদারি রাখে। মিয়ানমার ও ভারত থেকে গরু যেন না আসতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখা হবে কঠোরভাবে।”

কোরবানির পশুর হাটে স্বাস্থ্য বিধি এবং অন্যান্য শর্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা তদারকির জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মফিজুর রহমান।

স্বাস্থ্যবিধি ও অন্যান্য শর্ত মেনে চলছে কি না তা নিশ্চিত করতে প্রতিটি পশুর হাটে একটি করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।