র‌্যাবের মামলার পর সাহাবউদ্দিনের ছেলে গ্রেপ্তার

ঢাকার সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলার পর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল আল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

লিটন হায়দার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 July 2020, 06:12 PM
Updated : 20 July 2020, 08:39 PM

ফয়সাল সাহাবউদ্দিন মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহাবউদ্দিনের  ছেলে।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে রোববার ওই হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে নানা অনিয়ম পাওয়ার কথা জানানোর পর সোমবার রাতে ফয়সালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করে র‌্যাব।

সেই মামলায় রাতেই ফয়সালকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক এএসপি সুজয় সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।

এর আগে বিকালে সাহাবউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, তার ছেলে ফয়সল ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত’। তাকে একটি হোটেলে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে।

বনানীর ‘সুইট ড্রীম’ হোটেল থেকে ফয়সালকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে র‌্যাবের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ওই হোটেলটির মালিক সাহাবউদ্দিন।

র‌্যাবের নায়েব সুবেদার ফজলুল বারীর করা মামলার বাকি দুই আসামি সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আবুল হাসনাত ও স্টোর কিপার শাহরিজ কবিরকে রোববার অভিযানের সময়ই গ্রেপ্তার করা হয়।

গুলশান থানায় করা এই মামলায় বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ দণ্ডবিধির নানা ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

র‌্যাবের র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ এর আগে বলেছিলেন, হাসপাতালটির বিরুদ্ধে ৯ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাভাইরাস পরীক্ষায় সরকার কর্তৃক র‌্যাপিড টেস্টের অনুমোদন না থাকলেও তারা সেটা করেছে। পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া প্রতিবেদন দিয়েছে। করোনাভাইরাস নেগেটিভ রোগীকে পজিটিভ দেখিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। ভিন্ন ল্যাব থেকে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা করিয়ে নিজেদের প্যাডে প্রতিবেদন দিয়েছে।

হাসপাতালটির লাইসেন্সের মেয়াদ এক বছর আগে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তা নবায়ন করা হয়নি বলেও র‌্যাবের অভিযোগ।

মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহাবউদ্দিনের ছেলে ফয়সলের নির্দেশে ডা. আবুল হাসনাত অন্যদের সহযোগিতায় এসব অপরাধের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করেছে।

এজাহারে বলা হয়, নানা সূত্রে অভিযোগ পেয়ে রোববার অভিযান চালানোর সময় তিন তলায় ডা. আবুল হাসনাতের কক্ষে গিয়ে র‌্যাপিড টেস্ট কিট আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেন। পরে তার কক্ষে তল্লাশি করে ‘হাইটপ ওয়ান স্টেপ র‌্যাপিড টেস্ট’ লেখাযুক্ত বক্স পাওয়া যায়, যার ভেতর ৯টি র‌্যাপিড টেস্ট কিট ছিল। এছাড়া আবুল হাসনাতের স্বাক্ষর করা অ্যান্টিবডি টেস্টের চারজনের প্রতিবেদনও পাওয়া যায়।

অনুমোদনহীন র‌্যাপিড টেস্টের মাধ্যমে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেওয়া ছাড়াও করোনাভাইরাস নেগেটিভ রোগীদের পজিটিভ বানিয়ে ভর্তি রাখা, আইসিইউতে রেখে প্রচুর পরিমাণ বিল করার অভিযোগও করা হয় এজাহারে।

মামলায় এনামুল হক নামে এক রোগীর ছেলের অভিযোগ দিয়ে বলা হয়, অভিযানের খবর পেয়ে তিনি হাসপাতালে এসে জানান যে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য তার কাছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা নিলেও কোনো প্রতিবেদন না দিয়ে মৌখিকভাবে ‘নেগেটিভ’ বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।

“এছাড়া অন্য এক রোগীর কোভিড-১৯ পরীক্ষা ঢাকার বাইরে একটি হাসপাতাল থেকে করিয়ে পজিটিভ দেখিয়ে ভর্তি করানো হয়। পরে ওই রোগীর স্বজনের সন্দেহ হলে ঢাকার একটি হাসপাতালে পরীক্ষা করালে ফল নেগেটিভ আসে।”

মামলায় বলা হয়, হাসপাতালের চতুর্থ তলায় অস্ত্রোপাচার কক্ষে মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন ধরনের মেডিকেল সামগ্রী পাওয়া যায়। এরমধ্যে ২০১৩ সালে মেয়াদ শেষ হয়েছে, এমনও মেডিকেল সামগ্রীও জব্দ করা হয়েছে।

প্রধান আসামি ফয়সল আল ইসলামের নির্দেশে অধিক টাকা আদায়ের মতলবে এ সব মেয়াদোত্তীর্ণ মেডিকেল সামগ্রী সংরক্ষণ করা হয় বলে র‌্যাবের দাবি।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. হাসনাতকে চেয়ারম্যান সাহাবউদ্দিনের ছেলে ফয়সলের ‘দুষ্কর্মের সহযোগী’ উল্লেখ করা হয় মামলায়।

“তারা পরস্পর যোগসাজসে চিকিৎসার নামে প্রতারণা, জাল-জালিয়াতির নামে প্রতিবেদন প্রদান, চোরাচালানের মাধ্যমে চীন থেকে র‌্যাপিড কিট আনাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করেছে।”

সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

অভিযোগ প্রত্যাখ্যান

তবে র‌্যাবের তোলা নানা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সোমবার সংবাদ সম্মেলন করেছে সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ।

করোনাভাইরাস শনাক্তে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট ব্যবহার নিয়ে তারা বলছে, এটা চিকিৎসকের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তার দায় তাদের উপর বর্তায় না।

র‌্যাব বন্ধ করে দেওয়ার পর রোগীদের চলে যাওয়ার মধ্যে সোমবার বিকালে হাসপাতাল চত্বরে সংবাদ সম্মেলনে আসেন কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. জাফর উল্লাহ।

তিনি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আনা হচ্ছে, এগুলো ঠিক নয়। তবে ফার্মেসির ক্ষেত্রে একটা ত্রুটি ছিল। লাইসেন্স আপডেট ছিল না।

তিনি জানান, গত ২ জুন থেকে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ড চালু করেন তারা। পরে কোভিড- ১৯ ইউনিট চালু হয়।

করোনাভাইরাসের ২২০ জন রোগী সাহাবউদ্দিনে ভর্তি হয়েছিলেন জানিয়ে ডা. জাফর বলেন, এর মধ্যে ১৯২ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।

অন্য স্থানে পরীক্ষা করিয়ে আসার পর ‘পজিটিভ’ রোগীদের এখানে ভর্তি করা হত বলে জানান তিনি।

অনুমোদন না নিয়ে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার অভিযোগে রোববার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে গুলশানের সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব।

অধ্যক্ষ বলেন, তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে কোভিড- ১৯ পরীক্ষার অনুমোদন পেলেও পিসিআর মেশিন সময়মতো দেশে না আসায় তাদের অনুমোদন স্থগিত করা হয়।

তিনি জানান, তাদের এখানে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হত না। তারা প্রাভা হেলথ কেয়ার ও ইন্টান্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে চুক্তির ভিত্তিতে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে আনতেন।

পরীক্ষার প্রতিবেদন সাহাবউদ্দিনের প্যাডে দেওয়ার বিষয়ে ডা. জাফর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী তা করা হত।

তবে প্রাভা হেলথ কেয়ারের পরিচালক ডা. শিমিন এম আকতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, চুক্তিতে এমন কিছু ছিল না।

“যদি তারা তা করে থাকে, তারা এটা ঠিক করেনি।”

তিনি জানান, গত ২৫ জুন চুক্তি সইয়ের পর ওই মাসে ২-৩ জনের নমুনা পাঠিয়েছিল সাহাবউদ্দিন মেডিকেল, জুলাই মাসে মাত্র একজনের নমুনা পাঠিয়েছে।

গণস্বাস্থ্যে র‌্যাপিড কিট ব্যবহারের বিষয়ে গ্রেপ্তারকৃত চিকিৎসকের দিকে ইঙ্গিত করে কলেজ অধ্যক্ষ জাফর উল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “গণস্বাস্থ্যের কিট ব্যবহার যিনি করেছেন, এটা তার দায় তাকেই নিতে হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নেবে না।”

রোববার গ্রেপ্তারের সময় ডা. হাসনাত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যারা প্লাজমা দিচ্ছেন, শুধু তাদের নিয়ে কাজ করেছিলেন তারা। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের র‌্যাপিড টেস্ট কিট তারা নিজেরাই এনে পরীক্ষামূলক ব্যবহার করছিলেন।

অধ্যক্ষ জাফর উল্লাহ বলেন, “এ বিষয়ে হাসপাতাল বা কলেজ অবগত নয়। এটা আমাদের আওতার মধ্যে না। এটা কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে করে থাকে, এটাও আমাদের অনুমোদিত না।”

অনুমোদন না নিয়ে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার অভিযোগ পেয়ে রোববার ঢাকার গুলশানের সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে সহকারী পরিচালক আবুল হাসনাতকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোর হুঁশিয়ারি

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে কোনো চিকিৎসক কিংবা স্বাস্থ্যকর্মীর বিরুদ্ধে ‘অযাচিত’ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন।

সাহাবউদ্দিন থেকে এক চিকিৎসককে গ্রেপ্তারের পর সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

এতে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর বিরুদ্ধে ‘অযাচিতভাবে’ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুমকির পাশাপাশি চলমান পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই চিকিৎসক, নার্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টি ও অযথা হয়রানি না করার আহ্বান জানানো হয়।

 “কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তা প্রচলিত আইনের মা্ধ্যমে তদন্ত করে যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।”

সোমবার সকালে অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিকালে এই বিজ্ঞপ্তি দেয় বলে সংগঠনের সভাপতি মবিন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

তিনি বলেন, “কেউ অন্যায্য করে থাকলে আর এটা প্রমাণিত হলে তার পাশে তারা থাকবেন না।

তিনি বর্তমান এই পরিস্থিতিতে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।”

সাহাবউদ্দিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল এই অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য।

সাহাবউদ্দিন এক সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-অর্থ বিষয়ক সম্পাদক এবং ঢাকা মহানগর উত্তরের সহ-সভাপতি ছিলেন। তবে ২০১৯ সালে তিনি পদত্যাগ করে বিএনপি ছাড়েন।