মৃত্যুদণ্ডাদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন যুদ্ধাপরাধী আজহারের

মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামকে সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 July 2020, 11:02 AM
Updated : 19 July 2020, 11:02 AM

রোববার দুপুরে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় দাখিল করা হয় বলে তার আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির জানিয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আপিল বিভাগের রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর আমরা রিভিউ পিটিশন দায়ের করেছি। আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম অনুযায়ী কার্যতালিকায় এলে আমরা শুনানি করব।”

২৩ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ১৪টি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান এ আইনজীবী।

গত বছর ৩১ অক্টোবর সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে এ টি এম আজহারুল ইসলামকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল থাকে।

আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে আসামিপক্ষের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করার নিয়ম রয়েছে। গত ১৬ মার্চ এই মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়।

সে হিসাবে রিভিউ আবেদনটি কেন এতদিন পর করা হল তার ব্যাখ্যায় আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “যেহেতু আদালত বন্ধ ছিল, লিমিটেশন অ্যাক্টের নিয়ম হল, বন্ধ যে সময়টা থাকবে সে সময়টা বাদ যাবে। রোববার থেকে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ শুরু হয়েছে। তাছাড়া রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি ছাড়া তো রিভিউ ফাইল করা যায় না। আজ সেটি পাওয়ার পর রিভিউ ফাইল করা হয়েছে।”

করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় চার মাস বন্ধ থাকার পর গত সপ্তাহ থেকে ভার্চুয়ালি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারিক কাজ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

গত সপ্তাহে দুইদিন (সোম ও বৃহস্পতিবার) ভার্চুয়াল উপস্থিতি ও শুনানির মাধ্যমে আপিল বিভাগ চললেও রোববার থেকে প্রতিদিন বিচারকাজ চালানোর সিদ্ধান্ত দেন প্রধান বিচারপতি।

সে অনুযায়ী রোববার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির ভার্চুয়াল আপিল বেঞ্চে চলে বিচারকাজ।

আজহারের রিভিউ শুনানি ভার্চুয়াল বেঞ্চেই হবে কিনা এমন প্রশ্নে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, “আগামীকাল বিষয়টি মেনশন করব। কোর্ট যে সিদ্ধান্ত দেবে সেভাবেই শুনানি করব।”  

জামায়াতের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলে এ টি এম আজহার একাত্তরে ছিলেন ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর রংপুর শাখার কমান্ডার।

সে সময় তার নেতৃত্বেই বৃহত্তর রংপুরে গণহত্যা চালিয়ে ১৪শ’র বেশি মানুষকে হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল বলে এ মামলার বিচারে উঠে আসে।

২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে তিন অভিযোগে আজহারের মৃত্যুদণ্ড এবং দুই অভিযোগে মোট ৩০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। আপিলের রায়েও রংপুর অঞ্চলে গণহত্যা ও হত্যার তিন ঘটনায় তার মৃত্যুদণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতের ভিত্তিতে বহাল থাকে।

২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের রায়ে বলেছিল, “যে ঘৃণ্য অপরাধ আজহারুল ইসলাম করেছেন, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো সাজায় তার সুবিচার হয় না।”

আপিলের রায়ে এ মামলার দ্বিতীয় অভিযোগে রংপুরের বদরগঞ্জ থানার মোকসেদপুর গ্রামে গুলি চালিয়ে ১৪ জনকে হত্যা, তৃতীয় অভিযোগে বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিলের আশপাশের গ্রামে এক হাজার চারশর বেশি হিন্দু গ্রামবাসীকে গুলি চালিয়ে হত্যা এবং চতুর্থ অভিযোগে কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপকের স্ত্রীকে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে আজাহারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

এ মামলার প্রথম সাক্ষী ছিলেন একজন বীরাঙ্গনা, যাকে রংপুর টাউন হলে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল।

রিভিউয়ে কী কী যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে জানতে চাইলে আজহারের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “১৪টি যুক্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, অভিযোগ গঠনের আদেশ অনুযায়ী দুই নম্বর অভিযোগের ঘটনাস্থল হচ্ছে মোকসেদপুর গ্রাম। অথচ রাষ্ট্রপক্ষের তিন নম্বর সাক্ষী মোখলেসুর রহমান সরকার ওরফে মোখলেস আলী তার জবানবন্দিতে ঘটনাস্থল বলেছেন উত্তর রামনাথপুর। আপিল বিভাগ ঘটনাস্থল সংক্রান্ত পরস্পরবিরোধী এই বক্তব্যের সন্তোষজনক সমাধান না করেই আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।

“রাষ্ট্রপক্ষের তিন ও ছয় নম্বর সাক্ষীর (মোখলেসুর রহমান ও মো. মোকবুল হোসেন) দাবি অনুযায়ী, তারা ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। অথচ তাদের জবানবন্দিতে দেখা যায়, ওই সময় তিন নম্বর সাক্ষী পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার এবং ছয় নম্বর সাক্ষী তিন থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিলেন। আপিল বিভাগ সাক্ষীদের বক্তব্যের এই বৈপরীত্য বিবেচনায় না নিয়েই জনাব ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।”

শিশির মনির বলেন, “এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের চার নম্বর সাক্ষী (মো. মেছের উদ্দিন) জেরায় স্বীকার করেছেন যে, ঝাড়ুয়ার বিলের ঘটনায় এ টি এম আজহারুল ইসলাম জড়িত নন। আপিল বিভাগ মতামত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভুলবশত ‘ইহা সত্য নহে’ শব্দসমূহ উল্লেখ করতে পারেনি এবং এ কারণে এটিএম আজহারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। মামলার নথিপত্রে উল্লেখিত সাক্ষ্যপ্রমাণ অনুযায়ী তিনি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

“আরেকটি যুক্তিতে আমরা বলেছি, রাষ্ট্রপক্ষের দাখিলকৃত প্রদর্শনী নম্বর ২৫ অনুযায়ী আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটে জড়িত থাকার মতো কোনো সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষের এই দালিলিক প্রমাণ বিবেচনায় না নিয়েই তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।”

আজহারের আইনজীবী বলেন, “এছাড়া আপিল বিভাগ রায়ে উল্লেখ করেছেন যে, রাষ্ট্রপক্ষের নয় নম্বর সাক্ষীর জবানবন্দিতে এটিএম আজহারুল ইসলাম কোনো আপত্তি জানাননি। অথচ নথিতে দেখা যায় যে, নয় নম্বর সাক্ষীর (শোভা কর) জবানবন্দিতে সুনির্দিষ্টভাবে আপত্তি জানানো হয়েছে।

“আরেকটি যুক্তিতে আমরা বলেছি, রাষ্ট্রপক্ষের ১০ নম্বর সাক্ষী তার জবানবন্দিতে বলেছেন যে, তিনি এ টি এম আজহারুল ইসলামকে ১৯৭১ সালে চিনতেন, কারণ এ টি এম আজহার তখন কারমাইকেল কলেজের ছাত্রনেতা ছিলেন। অথচ এই সাক্ষী তৎকালীন ছাত্রলীগ বা ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের নাম বলতে পারেননি। এমনকি কারমাইকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষের নামও তিনি বলতে পারেননি। রায়ে আপিল বিভাগ সাক্ষীর এই জবানবন্দির অংশ বিবেচনায় না নিয়েই তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।

“তাছাড়া স্বীকৃত মতে আজহারুল ইসলাম ১৯৭১ সালে ১৮ বছর বয়সে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র ছিলেন। অথচ সকল হত্যাকাণ্ডের দায় তার উপর চাপানো হয়েছে। আপিল বিভাগ সে সময়ে তার এই সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় না নিয়েই তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন।”

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ২২ অগাস্ট মগবাজারের বাসা থেকে আজহারকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ১২ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার বিচার।

রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে এবং তাতে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে আসামিকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।

আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধ মামলায় এর আগের সাতটি রায়ের মধ্যে ছয়টিতে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দলটির শুরা সদস্য মীর কাসেম আলী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের রিভিউ আবেদনেও তাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপিলের নিষ্পত্তি হয়ে যায়।