মহামারীকালেও ভোটে এত সাড়া!

গত কয়েকটি নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার খরা দুঃশ্চিন্তায় ফেলেছিল খোদ নির্বাচন কমিশনকেও। মহামারীকালে নিয়ম রক্ষার দুটি উপনির্বাচনে ভোটার নিয়ে খুব একটা চিন্তা ছিল না; কিন্তু ভোটের হার দেখে এখন নির্বাচন কর্মকর্তারাও অবাক।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 July 2020, 11:42 AM
Updated : 18 July 2020, 01:47 PM

গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত সংসদের দুটি আসনে উপনির্বাচনে যশোর-৬ আসনে ভোট পড়েছে ৬৩.৫ শতাংশ। আর বগুড়া-১ আসনে ভোট দিয়েছে ৪৫.৫ শতাংশ ভোটার। দুটি আসনে গড় ভোটের হার ৫৫ শতাংশ।

নির্বাচনে কত ভোটার উপস্থিতি থাকতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা তো নেই। সেক্ষেত্রে দুই উপনির্বাচনে যা হয়েছে তাতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে ইসি সচিবালয়ও।

২০১৪ সালে অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটের হার কমতে থাকে।

২০১৫ সালে ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটিতে ভোট পড়েছিল ৪৩%। এবছরের শুরুতে ঢাকা সিটি নির্বাচনে ভোটের হার দক্ষিণে ২৯ শতাংশ ও উত্তরে ২৫ শতাংশে নেমে আসে।

তবে চার মাস আগে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে ২১ মার্চ গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪ আসনে উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল যথাক্রমে ৬০ ও ৬৯ শতাংশ।

বগুড়া ও যশোর উপনির্বাচনের আবহই ছিল ভিন্ন। একে তো ছোঁয়াচে রোগ কোভিড-১৯ সংক্রমণের ভয়ে বাইরে যেতে মানা, তার উপর ছিল বন্যা; এর মধ্যে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাও ছিলেন না ভোটের মাঠে।

তারপরও ভোটের হার তুলনামূলক বেশি দেখে যশোর উপনির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সত্যি, আমি নিজেও এত ভোটার উপস্থিতি প্রত্যাশা করিনি।

“মহামারীতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে যেখানে ভোট করাই চ্যালেঞ্জের, সেখানে সকাল সকাল উপস্থিতি ছিলই বেশ। বন্যা ছিল না যশোরে, সঙ্গে সচেতনতা কেন্দ্রে উপস্থিতিতে ভূমিকা রেখেছে। যশোরে প্রাথমিকভাবে আমরা সফল হয়েছি।”

যশোর-৬ আসনে একটি ভোটকেন্দ্রের চিত্র

ভোটে কোনো অনিয়মের অভিযোগ আসেনি বলে জানান রিটার্নিং কর্মকর্তা হুমায়ুন। তবে কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর কোনো এজেন্ট ছিল না। কিছু কিছু কেন্দ্রে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর এজেন্ট ছিল।

মহামারীর কারণে ঝুলে যাওয়া এই উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আগেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ভোট আয়োজনের পক্ষপাতি ছিল না দলটি।

রিটার্নিং কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, “সত্যি বলতে কি, ভোটে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলে এমনিতেই অনিয়ম বন্ধ হয়ে যায়। প্রার্থীরা সক্রিয় থাকলে তাদের এজেন্টও থাকে, চেক এ্যান্ড ব্যালেন্স থাকে।

“মহামারীকালে ভোটের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন কমিশনে একটি প্রস্তাবও পেশ করব ভাবছি। যা অভিজ্ঞতা আগামীতে নির্বাচনী ম্যানেজমেন্টে কাজে লাগতে পারে।”

যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে দুই লাখ তিন হাজার ভোটারের মধ্যে এক লাখ ২৯ হাজার ৬৭ জনের ভোটগ্রহণ হয়েছে।

নৌকার প্রার্থী যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার একই পেয়েছেন এক লাখ ২৪ হাজার ৩ ভোট। ভোট থেকে সরে দাঁড়ালোও বিএনপির প্রার্থী আবুল হোসেন আজাদ দুই হাজার ১২ ভোট এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাবিবুর রহমান ১ হাজার ৬৭৮ ভোট পেয়েছেন।

বগুড়া-১ আসনে (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) ৩ লাখ ৩০ হাজার ৯১৮ ভোটের মধ্যে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৪৩১টি গ্রহণ হয়েছে।

নৌকা প্রতীকে ১ লাখ ৪৫ হাজার ২৯৫ ভোট পেয়ে জয়ী হন আওয়ামী লীগের সাহাদারা মান্নান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াসির রহমতুল্লাহ ইন্তাজ (ট্রাক) পেয়েছেন ১ হাজার ৫৬৩ ভোট।

বগুড়ার একটি কেন্দ্রে ভোট শুরুর আগে ভোটারদের হাতে দেওয়া হয় স্যানিটাইজার

বগুড়া উপনির্বাচনে বন্যার কারণে তিন দফায় ১৬টি কেন্দ্র পরিবর্তন করতে হয়েছে শেষ মুহূর্তে। উঁচু ও নিরাপদ স্থানে অস্থায়ী কেন্দ্র করতে হয়েছে।

মহামারী ও বন্যার মধ্যে ভোটের এ অভিজ্ঞতার বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহবুব আলম শাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমন সময়ে ভোট করা ছাড়া উপায়ও ছিল না। এর মধ্যেও এত (৪৬%)  উপস্থিতি বেশ আশাব্যঞ্জক।”

ভোটে কোনো অনিয়ম ছিল না দাবি করে তিনিও বলেন, “জাল ভোট দেওয়ার প্রচেষ্টায় কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে, জরিমানা ও দণ্ড দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রে কেন্দ্রে দায়িত্বশীলরাই এ বিষয়ে সজাগ ছিল।”

ভোট করা ছাড়া উপায় ছিল না

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এই দুই উপনির্বাচন আয়োজন নিয়ে সমালোচনার মধ্যে রয়েছে ইসি, যদিও সাংবিধানিক কারণে তারা ছিলেন নিরুপায়।

নির্বাচন কমিশন বলেছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রথম ৯০ দিনে ভোট না করলেও  দ্বৈব-দুর্বিপাকে পরবর্তী ৯০ দিনে করতে হল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে।

ইসির যুক্তি সমর্থন করছন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মানতেই হবে। একমাত্র যুদ্ধ ছাড়া মহামারী-বন্যার দোহাই দিয়ে ভোট বন্ধ রাখা যাবে না।

“সংসদ নির্বাচনের জন্য বেঁধে দেওয়া সময়ে নির্বাচন তো করতেই হবে। তা না হলে কন্সটিটিউশন ভায়োলেশন হবে।”

সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিয়ে এই নির্বাচন পেছানো যেত বলে কেউ কেউ মনে করেন।

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট তো সংবিধানের বাইরে নয়, সবাইকে সংবিধান মানতে হবে।”

বগুড়া-১ আসনের একটি ভোটকেন্দ্রের চিত্র

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা এর আগ বলেছিলেন, “নির্বাচন কমিশনের কাছে নির্বাচন পেছানোর আইনগত কোনো সুযোগ নেই। তবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে নিতে পারেন। আমরা রাষ্ট্রপতির শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তিনিও বলেছেন নির্বাচন না করার কোনো সুযোগ নেই।”

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অতীতে তিন মাসের (বিলুপ্ত তত্ত্বাধায়ক ব্যবস্থা) কথা বলে দুই বছর ক্ষমতায় থাকার নজির রয়েছে। এ ধরনের বিষয়ের পুনরাবৃত্তি রোধেই হয়ত ইসি সংবিধান নির্ধারিত সময়ে ভোটটি করে ফেলছে, যা আগামীর জন্যও বড় শিক্ষা।”

সাড়ে পাঁচ লাখ ভোটারের এ দুই উপনির্বাচনে নির্বাচন পরিচালনা, আইন শৃঙ্খলা ও সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে ব্যয় সাড়ে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়।

অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে আরও চারটি উপনির্বাচন করতে হবে ইসিকে।

এপ্রিল-মে মাসে শূন্য হওয়া পাবনা-৪ ও ঢাকা-৫ আসনের উপ নির্বাচন করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ৯০ দিনের মধ্যে করা সম্ভব হবে না জানিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে ইসি সচিবালয়।

সাংসদ শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর মৃত্যুতে পাবনা-৪ ও হাবিবুর রহমান মোল্লার মৃত্যুতে ঢাকা-৫ আসন শূন্য হয়।

মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া সিরাজগঞ্জ-১ আসন এবং সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া ঢাকা-১৮ আসনেও সামনে উপ নির্বাচন করতে হবে ইসিকে।