যেভাবে ‘গা ঢাকা’ দিয়ে ছিলেন সাহেদ

রিজেন্ট হাসপাতালে র‌্যাবের অভিযানে জালিয়াতি ধরা পড়ায় অবস্থা বেগতিক দেখে ঢাকা ছেড়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোহাম্মদ সাহেদ, বুধবার ভোরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে এই সপ্তাহ তার কীভাবে কেটেছে সেই বিবরণ দিয়েছেন র‌্যাবের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 July 2020, 06:29 PM
Updated : 15 July 2020, 07:03 PM

ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্ত থেকে সাহেদকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনায় তাকে।

বিকালে উত্তরায় র‌্যাব সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে আলোচিত এই আসামিকে গ্রেপ্তার নিয়ে কথা বলেন র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।

আত্মগোপনের দিনগুলোতে সাহেদ কোথায় কীভাবে ছিলেন সে বিষয়ে র‌্যাবপ্রধান বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদে সে বলেছে, ঢাকাসহ কক্সবাজার, কুমিল্লা, সাতক্ষীরার বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মগোপন করেছিল। বিভিন্নভাবে যানবাহন ব্যবহার করেছেন। কখনও হেঁটে, কখনও ট্রাকে, কখনওবা ব্যক্তিগত গাড়িতে করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গেছেন।”

কোভিড-১৯ চিকিৎসার নামে প্রতারণা আর জালিয়াতিতে দেশজুড়ে আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ বুধবার ভোরে সাতক্ষীরা সীমান্তে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর হেলিকপ্টারে করে তাকে ঢাকার পুরাতন বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

করোনাভাইরাস পরীক্ষার প্রতিবেদন নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়ার পর গত ৬ ও ৭ জুলাই উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব। তখন হাসপাতালটির নানা দুর্নীতি প্রকাশ পাওয়ার পর জানা যায়, এই হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ পার হয়ে গেছে বহু আগে।

এরপর সাহেদ লাপাত্তা হয়ে যান। আর র‌্যাবের ওই অভিযানের পর তার নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খবরও সংবাদ মাধ্যমে আসতে শুরু করে। কিন্তু তার হদিস মিলছিল না।

সাহেদকে গ্রেপ্তার অভিযানে অংশ নেওয়া র‌্যাবের শীর্ষ পর্যায়ের ওই কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গ্রেপ্তার হতে পারেন এমন আঁচ পেয়ে ৭ জুলাই রাতেই সাহেদ ঢাকা ছাড়েন। নরসিংদীর মাধবদীতে তার এক কর্মচারীর বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি।

“পরদিন নরসিংদী শহরে দিনভর ঘোরে সাহেদ। এরপর পুনরায় ঢাকায় ফিরে আসে। রাতেই আবার চলে যায় কক্সবাজারের মহেশখালী।”

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজের এক ভায়রার ভাই গিয়াসের গাড়িতে করে প্রথম দিন ঢাকা থেকে গেলেও পরে সাহেদ বিভিন্ন যানবাহন ব্যবহার করেন।

“মহেশখালী থেকে কুমিল্লায় ভাড়া গাড়িতে আসে। পরে সেখান থেকে একটি বড় কোম্পানির ট্রাকে করে ঢাকায় ঢুকে মানিকগঞ্জ চলে যায়।সেখান থেকে ১১ জুলাই ভাড়া করা গাড়িতে করে সাতক্ষীরা চলে যায়।

“সাতক্ষীরায় বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাসায় রাতের বেলা কাটিয়ে দিনের বেলা নানাভাবে ঘোরাঘুরি করে বাচ্চু মাঝির মাধ্যমে সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করছিল। তবে সীমান্ত পার করতে বাচ্চু মাঝির সাথে কত টাকার চুক্তি হয়েছিল, তা জানা যায়নি।”

রিজেন্‌ট চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদকে বুধবার সকালে সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্ত থেকে ধরে ঢাকায় আনার পর বিকালে উত্তরার র‌্যাব সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে আসেন র‌্যাবপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

র‌্যাবের মহাপরিচালকও সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সাহেদ তিন-চারটি জেলা ঘুরে পরিচিত কয়েকজনের সহায়তা নিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য নিজের জেলা সাতক্ষীরায় যান।

এই সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়েই তিনি এর আগে একবার অবৈধভাবে ভারতে গিয়েছিলেন বলে জানান র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান সারওয়ার বিন কাশেম।

“সে কারণে এলাকাটি তার বেশ পরিচিত।”

তিনি বলেন, আত্মগোপনে থাকার সময় সাহেদ ‘খুব দ্রুত স্থান পরিবর্তন করায়’ তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না।

বুধবার ভোরে সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্তবর্তী লবঙ্গবতী নদীর তীর থেকে একটি গুলিভর্তি পিস্তলসহ রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদকে আটক করে র‌্যাব।ছবি: র‌্যাব

“সাহেদ এ সময় চুলে কলপ করিয়েছিল ও গোফ ছোট করেছিল। প্রায় নয় দিন পালিয়ে থাকার সময় রাতের বেলায় খুব একটা ঘুমাত না। বিভিন্ন পরিচিত-স্বজনরা তাকে রাখতে চাইত না।”

গ্রেপ্তারের পর সাহেদ তাকে সংবাদমাধ্যমের সামনে না নিতে র‌্যাবকে অনুরোধ করেছিলেন বলে জানান একজন র‌্যাব কর্মকর্তা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকায় আনার পর তেজগাঁও বিমানবন্দরে তার পরিচিত এক সংবাদিককে ফটো তুলতে দেখে সাহেদ বেশ বিরক্ত হয়ে বলেছিল, সেও আমার এই অবস্থার ছবি তুলল!”

 গ্রেপ্তার অভিযানে অংশ নেওয়া র‌্যাব কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সাহেদ সাতক্ষীরায় মাহবুব ওরফে ইমন ওরফে পটল নামে একজনের সহায়তা নিয়ে অবস্থান করছিলেন এবং তিনিই তাকে ভারতে যেতে সহযোগিতা করছিলেন।

সাহেদসহ রিজেন্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় করা মামলায় আসামিদের মধ্যে মাহবুব নামে একজন রয়েছেন।

এই মাহবুবই কি মাহবুব ওরফে ইমন ওরফে পটল সে প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের মহাপরিচালক বলেন, “আমরা মামলা করার সময় প্রাথমিকভাবে যে নাম পেয়েছি সেগুলো দেওয়া হয়েছে। তদন্ত করে বলা যাবে এজাহারভুক্ত মাহবুবই সেই মাহবুব ওরফে ইমন ওরফে পটল কি না।”

সাহেদকে ঢাকায় আনার পর সকালে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের ৬২ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেটি সাহেদেরই আরেকটি অফিস বলে জানানো হয়েছে।

সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্তে বুধবার ভোরে ধরা পড়ার পর র‌্যাবের হেফাজতে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান বিতর্কিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাহেদ। ছবি: র‌্যাব

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের মহাপরিচালক আল মামুন বলেন, ওই কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে প্রায় এক লাখ ৪৬ হাজার জাল বাংলাদেশি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

ওই অফিসের বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা তার গোপন অফিস ছিল। সুনির্দিষ্ট কোনো অফিস ছিল এমন কিছু বলা যাবে না।”

বিকালে সাহেদকে মামলার তদন্তকারী সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে র‌্যাব। এরপর সরাসরি তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নেওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে বলে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানিয়েছেন।

সাহেদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ রিজেন্ট হাসপাতালকেন্দ্রিক।

বিতর্কিত ব্যবসায়ী রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকার উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের ৬২ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে অভিযানে যায় র‌্যাব। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

র‌্যাবপ্রধান বলেন, রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে কোভিড-১৯ এর প্রায় ১০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করে ছয় হাজারের মতো ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে তারা জানতে পেরেছেন। এছাড়া সাহেদ একদিকে রোগীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, অন্য দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে টাকা চেয়ে বিল জমা দিয়েছেন।

এছাড়াও সাহেদের বিরুদ্ধে আরও প্রতারণার খোঁজ বেরিয়ে আসছে এখন।

র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, রিকশাচালক, বালু ব্যবসয়ীদের সঙ্গে ব্যবসার নামে প্রতারণা ছাড়াও এমএলএম ব্যবসার নামে কোটি কোটি হাতিয়ে নেওয়ার খবরও মিলেছে।

তার বিরুদ্ধে কয়টি মামলা আছে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি আল মামুন।

তবে তিনি বলেন, “পঞ্চাশটির অধিক মামলা আছে, এ রকম শোনা গেছে। আমরা যাচাই করে দেখছি।”

এদিকে সাহেদ গ্রেপ্তার হওয়ার খবরে অনেকেই র‌্যাব কার্যালয়ে এসে অভিযোগ করেন।