করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
Published : 12 Jul 2020, 07:03 PM
রোববার বিকালে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের এক অফিস আদেশে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেকেজির চেয়্যারম্যান হয়ে সরকারি কর্মচারী বিধিমালা ভঙ্গ করেছেন ডা. সাবরিনা। সে কারণে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
২০১৫ সাল থেকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করে আসা ডা. সাবরিনা জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফুল হক চৌধুরীর স্ত্রী। সে কারণে সাবরিনা আরিফ চৌধুরী নামেই তিনি পরিচিত।
হাসপাতালের নাম ফলকে তার নাম ‘ডা. সাবরীনা আরিফ’ লেখা হয়েছে, যদিও সরকারি নথিতে তার নাম সাবরিনা শারমিন হুসাইন।
করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে সাবরিনার স্বামী আরিফুল গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। সাবরিনা জেকেজির চেয়ারম্যান ছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর এলেও বিষয়টি এখন তিনি অস্বীকার করছেন।
জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার, সংক্ষেপে জেকেজির বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে বুকিং বিডি ও হেলথকেয়ার নামে দুটি সাইটের মাধ্যমে টাকা নিচ্ছিল এবং নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া সনদ দিত।
এ বিষয়ে রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি বাড়ির কেয়ারটেকারের অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত ২২ জুন জেকেজি হেলথ কেয়ারের সাবেক গ্রাফিক ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে প্রতিষ্ঠানটির সিইও আরিফুলকেও গ্রেপ্তার করা হয়। জেকেজি হেলথ কেয়ারের নমুনা সংগ্রহের যে অনুমোদন ছিল, তাও ২৪ জুন বাতিল করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ ঘটনায় সাবরিনার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে গত কয়েক দিনে নানা আলোচনার পর রোববার দুপুরে তাকে হাসপাতাল থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের কার্যালয়ে ডেকে নেয় পুলিশ।
সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর বিকালে তাকে গ্রেপ্তার করার কথা জানান তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার হারুন অর রশিদ।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “তাকে তেজগাঁও থানায় দায়ের করা জেকেজির প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। সোমবার তাকে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ড চাওয়া হবে।”
এর ঘণ্টাখানেক পর ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইনকে বরখাস্তের অফিস আদেশ জারি করে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।
এ বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান স্বাক্ষরিত ওই আদেশে বলা হয়, “ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইন সরকারি চাকরিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেকেজির চেয়্যারম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া এবং অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এ কারণে তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
“সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সরকারের অনুমতি ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থাকা এবং অর্থ আত্মসাত সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেহেতু ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইনকে সরকারি কর্মচারী বিধিমালা-২০১৮ এর বিধি ১২ (১) অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।”
নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর নমুনা পরীক্ষার জন্য জেকেজি হেলথ কেয়ারকে দায়িত্ব দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তখন এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে ডা. সাবরিনার কথাই বলা হত।
গত জুন মাসের শুরুতে তিতুমীর কলেজের কর্মচারীদের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীদের মারামারির সময় সাবরিনা জেকেজির হয়ে কথা বলেছিলেন এবং ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেনও।
কিন্তু মাসের শেষ দিকে জেকেজির দুর্নীতির খবর প্রকাশ পাওয়ার পর তিনি দাবি করেন, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত দুই মাস ধরে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
করোনাভাইরাস মহামারীকালে জেকেজির অফিসে পুলিশের অভিযান এবং এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফকে গ্রেপ্তারের পর থেকে আলোচনায় ছিলেন ডা. সাবরিনা। রোববার দুপুর সোয়া ১টার দিকে পুলিশ তাকে ডেকে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের কার্যালয়ে।
সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর সাবরিনাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তেজগাঁও থানায়। তার আগেই তাকে গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ে।
বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে এসে উপ কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া প্রতিবেদনের মামলায় সাবরিনাকে তারা গ্রেপ্তার দেখিয়েছেন।
তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার রুবাইয়াত জামান জানান, জেকেজির বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রতারণার মামলা এবং থানায় হামলা, ভাংচুর পুলিশের কাজে বাঁধা দেওয়ার অভিযোগে।
প্রথম মামলাটি দায়ের করেন কামাল হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী। সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ, করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুযা প্রতিবেদন দেওয়া এবং জীবন বিপন্নকারী রোগের সংক্রামণের মধ্যে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হয় সেখানে।
ওই মামলায় গত ২৩ জুন অরিফুলকে গ্রেপ্তার করার পর জেকেজি কর্মীরা তেজগাঁও থানায় গিয়ে বিক্ষোভ করে। পরে পুলিশ বাদী আরকেটি মামলা করে এবং তাতে জেকেজির ১৮ কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আরিফের গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে দুইজন ব্যবসায়ী একই থানায় আরও দুটো মামলা করেন। এর একটিতে ১২টি ল্যাপটপ ভাড়া নেওয়ার নামে আত্মসাৎ করা এবং অন্যটিতে দুটি আর্চওয়ে এবং ২০টি ওয়াকিটকি কিনে টাকা না দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।
এর মধ্যে আরিফকে তিনটি প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে জানিয়ে রুবাইয়াত জামান বলেন, সাবরিনাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে প্রথম মামলায়। তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রতারণার বাকি দুই মামলাতেও তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
উপ কমিশনার হারুন বলেন, যে মামলায় সাবরিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার এজাহারে এই চিকিৎসকের নাম নেই।
“এ মামলায় হুমায়ুন কবীর ও তার স্ত্রী তানজিনাকে গ্রেপ্তারের পর তাদের দেওয়া তথ্যে আরিফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তদন্তে সাবরিনারও সম্পৃক্ততার তথ্য মেলে। সে কারণে আজ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে “
এক প্রশ্নের জবাবে হারুন অর রশিদ বলেন, “সাবরিনা যে জেকেজি হেলথকেয়ার এবং এর মূল প্রতিষ্ঠান ওভাল গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন সে ব্যাপারে কিছু তথ্য প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আরও কিছু জোগাড় করার চেষ্টা চলছে। রিমান্ডে নেওয়া হলে সব জানা যাবে।”
জেকেজিকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য সমুনা সংগ্রহের অনুমতি দিয়ে সমালোচনার মুখে থাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দেয়।
সেখানে বলা হয়, জেকেজির প্রধান সমন্বয়ক আরিফুল চৌধুরী ওভাল গ্রুপ লিমিটেড নামে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক। ওভাল গ্রুপ ২০১৮ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা সপ্তাহ ২০১৮, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব পালন করে।
“কোভিড সঙ্কট শুরু হওয়ার পর আরিফুল হক জানান, জেকেজি গ্রুপ দক্ষিণ কোরিয়ার মডেলে বাংলাদেশে কিছু বুথ স্থাপন করতে চায়। এসব বুথের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গবেষণাগারে সরবরাহ করবে। এজন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা সরকারকে কোনো অর্থ দিতে হবে না।
“ধারণাটি ভালো এবং কোভিড পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ বৃদ্ধি করার প্রয়োজন এই বিবেচনা থেকে ওভাল গ্রুপের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় জেকেজি গ্রুপকে অনুমতি দেওয়া যায় বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মনে হয়। পরবর্তীতে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়ায় বুথ পরিচালনার অনুমতি বাতিল করে।”
পুলিশ বলছে, জেকেজি হেলথকেয়ার থেকে ২৭ হাজার রোগীকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের নমুনা আইইডিসিআরের মাধ্যমে পরীক্ষা করানো হয়েছিল।
বাকি ১৫ হাজার ৪৬০টি প্রতিবেদন তৈরি করা হয় জেকেজি কর্মীদের ল্যাপটপে। জব্দ করা ল্যাপটপে এর প্রমাণও মিলেছে বলে জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, “দ্রুত কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের মূল লক্ষ্য ও সদিচ্ছা নিয়ে জেকেজিকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি প্রতারণা করতে পারে এমন ধারণা আদৌ ছিল না।”
আরও খবর