মহামারীতে ফুটছে না বিয়ের ফুল

পারিবারিকভাবে সব ঠিকঠাক, ছেলের মাস্টার্সের ফল বের হলেই ঘটা করে হবে বিয়ের আয়োজন। কিন্তু মহামারীতে আটকে গেছে সেই মাস্টার্সের পরীক্ষা; তাই বন্ধ হয়ে গেল বিয়ের আলাপও।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলাম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2020, 05:01 AM
Updated : 10 July 2020, 05:28 AM

পাত্রী তানিয়া কবির স্নাতকোত্তর শেষ করে ঢাকায় একটি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন; পাত্র তার ব্যাচমেট হলেও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে এখনও মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করতে পারেননি।

“পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়ের কথা পাকা হয়ে থাকলেও এখন আর এনিয়ে কোনো কথা হয় না। ওর মাস্টার্সের ফল না দেওয়া পর্যন্ত বিয়ে হবে না, বাড়ি থেকে জানিয়ে দিয়েছে,” হতাশার ‍সুরে বলেন তানিয়া।

প্রস্তুতি থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে তানিয়ার মতো অনেকের বিয়ে আটকে গেছে। এখন ধুমধাম করে বিয়ে আয়োজন সম্ভব নয় বলে অনেকে পিছিয়ে দিয়েছেন। আবার আর্থিক সঙ্কটে পড়ে কেউ কেউ বিয়ের কথা মাথায় আনছেন না।

গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন চলে সাধারণ ছুটি। ৩১ মে থেকে সীমিত পরিসরে অফিস খুলে দেওয়া হলেও ৬ অগাস্ট পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা আছে।

বিয়ে নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কাজীরা বলছেন, লকডাউনের ৬৬ দিনে বিয়ে একেবারেই বন্ধ ছিল। এখন অনানুষ্ঠানিকভাবে হাতেগোনা কিছু বিয়ে হচ্ছে।

ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকায় বিয়ে নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা মাসুম বিল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, লকডাউনে তো বিয়েই হয়নি, এখন স্বল্প পরিসরে হচ্ছে, তবে খুবই কম।

“হাতেগোনা দু’একটি বিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে হচ্ছে। সেখানে বিয়ে সম্পন্ন হতে যতজন মানুষ দরকার তার বেশি উপস্থিত থাকছেন না। আগেই বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল এমন কিছু বিয়ে এখন হচ্ছে।”

মহামারীর মধ্যে গত আড়াই-তিন মাস ধরে পকেটের টাকা খরচ করে কাজী অফিস চালাতে হচ্ছে বলে জানান মাসুম।

বাড্ডার কাজী মো. সালাউদ্দিন বলেন, “এখন বিয়ে হচ্ছে না বললেই চলে। কাজী অফিসের বাইরে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করতাম। এখন আর কোনো ডাক পাওয়া যাচ্ছে না, আমাদের এখন কোনো আয় নেই।”

কাবিননামায় ধার্যকৃত দেনমোহরের এক দশমিক ২৫ শতাংশ হারে কমিশন পান কাজীরা। এটাই তাদের আয়ের প্রধান উৎস। এছাড়া বিয়ে রেজিস্ট্রেশন বাবদ নিকাহ রেজিস্ট্রার ২৫ টাকা কমিশন এবং বিয়ে বাড়িতে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলে যাতায়াত ভাতা বাবদ মাইল প্রতি এক টাকা করে পান কাজীরা।

বিয়ের আয়োজন না থাকায় হাতে কোনো কাজও নেই বলে জানান ঢাকার দনিয়ার একটি কাজী অফিসের সহকারী হযরত আলী।

মহামারীকালে চাঁদপুরে বিয়ে বাড়িতে ভ্রাম্যমাণ আদালত

তার ভাষ্য, “করোনাভাইরাসের কারণে ঢাকার লোকজন কমে গেছে, মানুষের হাতে টাকা-পয়সা নেই। তাই এখন আর কেউ বিয়ের আয়োজন করছে না।”

সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর উনিয়নের শাহপরান উপশহর গ্রামের বিয়ের রেজিস্ট্রার ও কাজী মো. খলিলুর রহমান বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২/৩ মাস থেকে এলাকায় বিয়ে একেবারেই কমে গেছে।

“আগে মাসে ১৫/১৬টা করে বিয়ের রেজিস্ট্রি করতে হলেও এখন কোনো কোনো মাসে ৩/৪টা বিয়ের রেজিস্ট্রি হচ্ছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে আমরাও ভয় করি।

“আমরাই চাই না এই পরিস্থিতিতে বিয়ে হোক। আমরা বলছি, আগে সবকিছু ঠিক হোক, এরপর বিয়ের আয়োজন করবেন।”

করোনাভাইরাসে সংক্রমণের ভয়ের পাশাপাশি মানুষের হাতে টাকা না থাকায় বিয়ের সংখ্যা কমে গেছে বলে বলে মনে করেন খলিলুর।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার সাউদপাড়া গ্রামের কাজী কাজী আসাদুল হক ৪নং কোলকোন্দ ইউনিয়নের নয়টি ওয়ার্ডে বিয়ের নিবন্ধন করেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন বিয়ের রেজিস্ট্রি নাই বললেই চলে। করোনাভাইরাসের কারণে বিয়ে হচ্ছে না।”

বিয়ে রেজিস্ট্রি বন্ধ থাকলেও সরকারকে কাজীদের ফি ঠিকই দিতে হচ্ছে জানিয়ে আসাদুল বলেন, মার্চে একবার এবং জুলাই মাসে একবার ফি পরিশোধ করি। এই ফি’র এর বাইরে রেজিস্ট্রি বই ও ফরম তোলার খরচও আছে।”

ফরিদপুর পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ড এলাকায় বিয়ে নিবন্ধনের দায়িত্ব থাকা সাব্বির আহমেদ বলেন, এখন টুকটাক রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে, তবে সংখ্যায় খুব কম।

কেন বিয়ে হচ্ছে না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “অবস্থা তো আর আগের মতো নেই, মানুষ আতঙ্কিত। এক জায়গায় জড়ো হলে সংক্রমণের ভয় আছে।

“এই সঙ্কট কেটে গেলে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করে একটু ফুর্তি করা হবে, এজন্য অনেকেই এখন বিয়ের আয়োজন করছেন না।”

সাব্বির জানান, পৌর এলাকার কাজীদের বছরে দুই হাজার ৫৭৫ টাকা সরকারকে দিতে হয়।

লকডাউনের মধ্যে দলবল নিয়ে বিয়ে করে গত ৯ এপ্রিল চাকরি থেকে বরখাস্ত হন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার আমিনপুর ইউনিয়নের পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক শাহিন কবির। এই সময় বিয়ের আয়োজন করে সরকারি কর্মকর্তাসহ কয়েকজনকে সাজা এবং জরিমানা গুণতে হয়।

প্রস্তুতি থাকলেও এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অনেকে এখন বিয়ের আয়োজন করছেন না বলে মনে করেন ঢাকার বাসিন্দা ফরিদুর রহমান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিয়ে করতে গিয়ে যদি জরিমানা দিতে হয় সেটা কেউই চাইবে না। তার থেকে বড় কথা বিয়ের আয়োজন করলে কিছু লোকজনকে বলতে হবেই। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব নয়।”

মহামারীর মধ্যে সারা দেশে কত সংখ্যক বিয়ে হচ্ছে তার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ মুসিলম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইকবাল হোসেন। তার সমিতিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাড়ে সাত হাজার কাজী সদস্য বলে জানান তিনি।

ইকবাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনার মধ্যে সরকারি ছুটিতে বিয়ে একেবারেই হয়নি, এখন হাতেগোনা দু-একটি বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের সংখ্যা একেবারে কমে যাওয়ায় আমরা দৈন্যদশায় পড়েছি।

“আমাদের আর চলছে না। অফিস ভাড়া, স্টাফ খরচ, অফিসের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ চেয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলাম কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি।”

কাজীদের দুরবস্থার কথা জানাতে আইনমন্ত্রী এবং আইন সচিবের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করলেও এখনও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি বলে জানান ইকবাল।

তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী আমাদের দিকে তাকালে আমরা উপকৃত হব। আমাদের ওপর প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি পড়বে আমরা এখনও সেই আশায় আছি।”