লাইসেন্স নেই জেনেই রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি

লাইসেন্স না থাকায় তিন বার অভিযান চালানো হয়েছিল রিজেন্ট হাসপাতালে, করা হয়েছিল জরিমানা। তা জেনেই কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দিতে বেসরকারি এই হাসপাতালটির সঙ্গে চুক্তি করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 July 2020, 02:56 PM
Updated : 9 July 2020, 04:50 AM

গত ২১ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতালের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তৎকালীন সচিব আসাদুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদসহ ঊর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে কীভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চুক্তি করল- এ প্রশ্নে অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আমিনুল হাসান বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘বাধ্য হয়ে’ তা করেছিলেন তারা।

গত মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটার পর শুরুতে ছোঁয়াচে এই রোগে আক্রান্তদের আলাদা রেখে চিকিৎসা দিতে হাসপাতাল খুঁজে পাওয়াটা কঠিন ছিল বলে জানান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

ডা. আমিনুল বলেন, “তারা (রিজেন্ট) সার্ভিসটা দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছিল। তখন আমরা এই ধরনের হাসপাতাল খুঁজছিলাম। সে কারণে বিশেষ বিবেচনায় তাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।”

তখন লাইসেন্স নবায়নের শর্ত দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “শর্ত ছিল, তারা অবিলম্বে লাইসেন্স নবায়ন করে নেবে। আমরা তাদের দুবার রিমাইন্ডার দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা নবায়ন করেনি।”

এরপরও রিজেন্টের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপে যায়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কোভিড-১৯ পরীক্ষার সনদ জালিয়াতি, রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিষয়টি র‌্যাবের অভিযানে প্রকাশ্য হওয়ার পর গত মঙ্গলবার হাসপাতালটি বন্ধ করার নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

রিজেন্ট হাসপাতালের এক চিকিৎসক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাসপাতালটির লাইসেন্স না থাকার বিষয়টি তাদের জানা ছিল না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই চিকিৎসক বলেন, “যা ঘটেছে, তাতে আমরা নিজেরাও খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেছি। হাসপাতালে উপচেপড়া ভিড় ছিল। আমরা গত তিন মাস কী পরিশ্রম করেছি সেটা আমরাই জানি।

“অনেকেই আমরা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছি, সুস্থ হয়ে আবার চিকিৎসা দিতে এসেছি। আমাদের ডেডিকেশন শুধু মালিকের লোভের কাছে শেষ হয়ে গেল। আমাদের অবস্থাটা চিন্তা করেন কেমন আছি।”

কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার বিল বাবদ প্রায় ১ কোটি ৯৪ লাখ টাকার বিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল। 

তবে সে অর্থ পরিশোধ করা হয়নি বলে জানান অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. আমিনুল।

“তাদের সঙ্গে চুক্তি ছিল তারা বিনামূল্যে রোগীদের চিকিৎসা দেবে। কিন্তু তারা রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছিল। এ কারণে আমরা তাদের বিল পরিশোধ করিনি।”

রিজেন্টের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুক্তির সই হয়েছিল গত ২১ মার্চ

নানা অভিযোগে ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখায় অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় জাল সনদ তৈরির অভিযোগে আটজনকে আটক করে র‌্যাব। ঘটনার পর থেকে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ পলাতক।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ২০১৪ সালে এ হাসপাতালের অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়েছিল। কিন্তু নবায়ন না করেই চিকিৎসা দেওয়ার অভিযোগে ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে উত্তরা শাখায় এবং ২০১৮ সালে মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র‌্যাব।

সারোয়ার আলম জানান, মিরপুর শাখায় অভিযান চালিয়েছিলেন তিনি নিজেই। সে সময় ওই হাসপাতালের নানা অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ে তার। তখনও বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা না করে ভুয়া সনদ দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।

কোভিড-১৯ ‘ডেডিকেটেড’ হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্টের রোগীদের চিকিৎসার খরচ সরকারের বহনের কথা থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালটি রোগীদের কাছ থেকেও অর্থ নিচ্ছিল, আবার সরকারের কাছেও বিল জমা দিয়েছিল।

গত ৭ জুন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতার ৩৮ বছরের এক যুবক শ্বাসকষ্ট, জ্বরসহ কোভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ৯ জুন ওই যুবক মারা যান।

ওই যুবকের মামা মুমতাজ উদ্দিন বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসলে অনেক বিপদে পড়ে সেখানে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। বলতে গেলে বিনা চিকিৎসায় ছেলেটা মারা গেল। কিন্তু আমাদের কাছে ৪৮ হাজার টাকা বিল ধরিয়ে দেয়। পরে আমরা ৪২ হাজার টাকা দিই।

“পরে আসার সময় আবার তিন হাজার রাখে নমুনা পরীক্ষার জন্য। কিন্তু আমরা এখনও কোনো ফল পাইনি।”

এর আগে ১৮ মার্চ ওই হাসপাতালের আইসিইউ বিল বাবদ প্রতিদিন ১৫ হাজার টাকা দাবি করা হয় এক রোগীর স্বজনদের কাছে।

তখন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে যোগযোগ করা হলে রিজেন্ট হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা তারিক শিবলী বলেছিলেন, তাদের হাসপাতালে কোভিড-১৯ এর পরীক্ষা বিনামূল্যে করা হয়। তবে আক্রান্তরা অন্যান্য শারীরিক জটিলতায় ভোগেন, যার চিকিৎসার ব্যয় সরকার দেয় না বলে সেই অর্থই কেবল নেন তারা।

রিজেন্ট চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ

পরে রিজেন্ট্ হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “এটা একটা ভুল, আমি ওই ভদ্রলোকের মেয়ের মোবাইল নম্বর দিচ্ছি। আপনি চাইলে কথা বলতে পারেন। উনার মেয়ে আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে, তাদের কোনো অভিযোগ নেই।”

এর কিছুক্ষণ পর ওই রোগীর একজন স্বজন টেলিফোন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, এ নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই।

ওই ঘটনার চার দিন পর ওই রোগী মারা যান।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বুধবার ওই রোগীর একজন স্বজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই সময় গণমাধ্যমে খবর জানানোয় রিজেন্ট হাসপাতালের কর্মকর্তারা রোগীকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।

“তারা রোগীকে আইসিইউ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। রোগীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন ছিল বলে সে সময় আমরা আর কেউ কথা বলিনি।”

উত্তরা এলাকার বাসিন্দা এবং উত্তরারই একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানান, রিজেন্ট হাসপাতালের অপকর্মের কথা মোটামুটি সবাই জানেন। কিন্তু এর চেয়ারম্যান সাহেদের কারণে কেউ কিছু বলত না।

সাহেদ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন।

সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, সরকারি আমলাদের সঙ্গে তার ছবি এখন সোশাল মিডিয়ায় ঘুরছে।

আবার এর আগে বিএনপির বিভিন্ন নেতার সঙ্গেও তার সখ্যের খবর পাওয়া যায়।

সাহেদকে এখন খুঁজছে র‌্যাব। তাদের দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে, রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ ‘প্রকৃতপক্ষে একজন ধুরন্ধর, অর্থ লিপ্সু এবং পাষণ্ড’।