আরও দুই সপ্তাহ বন্যার ভোগান্তির শঙ্কা

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে দেশের প্রায় এক পঞ্চাংশ জেলায় বন্যার কবলে পড়েছেন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ, তাদের এই দুর্ভোগ আরও সপ্তাহ দুয়েক স্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2020, 07:27 PM
Updated : 6 July 2020, 07:38 PM

তবে দুর্যোগ মোকাবেলার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা বলছেন, এবার বন্যার আগেই ফসল ঘরে ওঠায় বানভাসী মানুষগুলোকে চরম দুরবস্থায় পড়তে হচ্ছে না। বন্যার কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা সামলে নিতে সহায়তার জন্য সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে।   

কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে এবারের বন্যায় অন্তত ১০ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যার বিস্তার কম হলেও এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় তিন লাখ পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। এ বন্যায় এরইমধ্যে উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভুইয়া সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলন, উত্তরে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে না হতে ফের নদ-নদীর পানি বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।

“ইতোমধ্যে সপ্তাহখানেক চলে গেল বন্যা পরিস্থিতি। এখন বন্যার অবস্থান মাঝারি রূপ নিচ্ছে। তার মানে আরও ১০-১২ দিন দুর্ভোগ থাকছে।”

সর্বশেষ গেল বছর জুলাইয়েও দেশের ২১ জেলায় বন্যার বিস্তার ছিল। মধ্যাঞ্চলেও  বন্যার বিস্তার ছিল বেশ কিছু দিন।

তুলনামূলকভাবে ২০১৭ সালের বন্যার মতোই বানভাসীদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে বলে ধারণা করেন এ প্রকৌশলীর।

সে বছর হাওরে আগাম বন্যার পর জুলাইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে মৌসুমের প্রথম বন্যায় অন্তত ১৩ জেলার অনেক উপজেলা প্লাবিত হয়। অগাস্টের বন্যায় ৩২ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পৌনে এক কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

শেরপুর সদর উপজেলার কুলুরচর-বেপারিপাড়ার এই বাড়িটি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

“গত ১০ বছরের মধ্যে ২০১৭ সালে বন্যার বিস্তার ছিল বেশ। কিন্তু এবার বিস্তার কম হলেও স্থায়িত্ব বেশি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ১০-১২ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে;  কোথাও উন্নতি হবে। আবার জুলাইয়ের ২০-২৫ তারিখ নাগাদ কোথাও কোথাও দুর্ভোগ থাকবে,” বলেন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী।

বিস্তার ও স্থায়িত্বে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের দুটি বন্যাকে ভয়াবহ বলা হয়। সে সময় অনেক এলাকায় বন্যা দুই মাসের বেশি সময় স্থায়ী হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ পায়।

২০১৭ সালে জুলাই-অগাস্টের দুই দফা বন্যা হয়। অগাস্টের বন্যায় দেশের ৩০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। সেবার বন্যায় মৃতের সংখ্যা ওই দুই বছরের হিসাব ছাড়িয়ে যায়।

১৯৯৮ সালে প্রায় ৬৮ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। আর ১৯৮৮ সালে বন্যা কবলিত হয়েছিল প্রায় ৬৪ শতাংশ এলাকা।

এবার জেলা বিবেচনায় ইতোমধ্যে দেশের এক পঞ্চমাংশ জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যার বিস্তার ঘটেছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ নিয়ে অভিজ্ঞতা তুলে ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্লানিং) সাইফুল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৯৮ সালের বন্যা ছিল বেশ ভয়াবহ। সে পরিস্থিতির সঙ্গে এবারের পরিস্থিতির তুলনা করার ‘সময় হয়নি’। জুন থেকে অগাস্ট উত্তর পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে বন্যা হয়ে থাকে। কিন্তু এবারের বন্যায় তুলনামূলক তেমন ফসল ও অর্থনৈতিক ক্ষতিই হয়নি।

“সাধারণত জুনে আগাম ফ্লাশ ফ্লাড হয়। এবার তা হয়নি। এরইমধ্যে আমাদের ফসল শতভাগ ঘরে উঠে গেছে। এখন বন্যা হলেও ক্ষতি নেই। এটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি; সহনীয় মাত্রার বন্যা যাকে বলে। এটা নিয়ে ভীত হওয়ার কারণ নেই,” বলেন তিনি।

মহামারীর এ সময়ে বন্যা নিয়েও ভীতি-উদ্বেগ না ছড়ানোর পরামর্শ দেন সাইফুল হোসেন।

তিনি বলেন, “বন্যায় ক্ষতি হয়, লাভও রয়েছে। এ সময়ে বন্যায় আর্থ-সামাজিক লাভ রয়েছে হাওরাঞ্চলে। এখনও সহনীয় সীমায় রয়েছে তা। অগাস্টে কী হয় দেখা যাক। ভয়াবহ রূপ নেবে না আশা করি। মহামারীর মধ্যে বন্যার ভীতি ছড়িয়ে পড়লে এক শ্রেণির সুবিধাভোগীও এর ফায়দা দেবে। বানভাসী মানুষের সহায়তার পাশাপাশি গণমাধ্যমসহ সবাইকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে হবে।”

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহসীন।

কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর বাঁধে আশ্রয় নেওয়া এই পরিবার গত আট দিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

তিনি সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা মহামারীর মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় বেশ সফল হয়েছি। অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার বন্যাও মোকাবেলা করব। এ লক্ষ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।”

তিনি জানান, বন্যাপ্রবণ এলাকায় ফসল ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে মানুষকে ‘সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে’। জুলাই-অগাস্ট নাগাদ কৃষির আগাম প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতিও হচ্ছে।

“অনুমান বা মডেলভিত্তিক নানা শঙ্কা থাকতে পারে। কিন্তু ভীতি নয়, অভিজ্ঞতার আলোকে এগোচ্ছি আমরা। আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে তা মোকাবেলার। প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। ফসল উঠে গেছে, মাঠ ফাঁকা। ক্ষতি তেমন হবে না; দুর্ভোগ যেন কম হয় সেজন্য খাদ্য সরবরাহ, ত্রাণ বরাদ্দ প্রচুর রয়েছে আমাদের।”

পানিবন্দি লাখো পরিবার

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনিশেন সেন্টার (এনআরডিসিসি) জানিয়েছে, এবারের বন্যায় বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সরকার বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ হিসেবে প্রায় ১১ হাজার মেট্রিক টন চাল, প্রায় দুই কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

বন্যায় ১৪ লাখের মতো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

লালমনিরহাট: ‍উপদ্রুত এলাকার চার উপজেলার ইউনিয়ন ২১টি। ক্ষতিগ্রস্ত ৪৮ হাজারেরও বেশি মানুষ।

কুড়িগ্রাম: নয় উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়ন দুর্গত। প্রায় ১৬ হাজার পরিবার পানিবন্দি, ক্ষতিগ্রস্ত ৬২ হাজারের বেশি লোক।

গাইবান্ধা: চার উপজেলার ২৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত। এখানে ৩১ হাজার পরিবার পানিবন্দি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সোয়া এক লাখ মানুষ।

নীলফামারী: দুটি উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের প্রায় ১৩ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায়।

রংপুর: ছয়টি ইউনিয়নের কয়েকশ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।

সুনামগঞ্জ: বন্যায় সব উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ জেলার ৮৩টি ইউনিয়নের ৩৬ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।

সিরাজগঞ্জ: প্রায় ৩৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা এক লাখ ৬০ হাজার।

বগুড়া: প্রায় ১৯ হাজার পরিবার পনিবন্দি। এখানে ৭৭ হাজার মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জামালপুর: বিরাজমান বন্যায় প্রায় অর্ধশত ইউনিয়নের ৯০ হাজারেরও বেশি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত চার লাখ মানুষ।

সিলেট: ৩২টি ইউনিয়নের ৩৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি। এ জেলার দেড় লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।

টাঙ্গাইল: এই জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এক লাখ ২৯ হাজার মানুষ।

ফরিদপুর: সোয়া দুই লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এছাড়া রাজবাড়ী, মাদারীপুর ও মানিকগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের অনেক এলকা প্লাবিত হয়েছে। তাতে দুর্ভোগে রয়েছে মধ্যাঞ্চলের বহু মানুষ।

তিন নম্বর সতর্কতা সাগরে

আষাঢ়ের শেষ দিকে এসে মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় ফের বর্ষণও বাড়ছে। এরইমধ্যে স্বল্পমেয়াদি বন্যা বিরাজ করছে। ভরা বর্ষায় বন্যায় দুর্ভোগের শঙ্কাও বাড়ছে।

সোমবার জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ খো. হাফিজুর রহমান জানান, সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করায় সাগরে ঝড়ো হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এজন্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

জুলাই মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসের বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ জানান, এ মাসের মৌসুমী ভারি বর্ষণের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর মধ্যাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের কিছু স্থানে বন্যা থাকতে পারে।

অপর দিকে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থতির সৃষ্টি হতে পারে।