নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের সুযোগ ফিরল

করোনাভাইরাস সংকটে তিন মাসের মতো বন্ধ থাকার পর ফৌজদারি মামলার আসামিদের আবার নিম্ন আদালতে আতসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 July 2020, 04:47 PM
Updated : 4 July 2020, 05:33 PM

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে মার্চের শেষ দিকে সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণায় আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১১ মার্চ ভার্চুয়াল আদালত চালু হলেও শুধু নতুন গ্রেপ্তার ও আগে থেকে বন্দিদের জামিন শুনানি হয়।

এখন থেকে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তরা দেশের মুখ্য বিচারিক হাকিম এবং মুখ্য মহানগর বিচারিক হাকিম আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পারবেন বলে শনিবার সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে।   

এক্ষেত্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জারি করা স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক-সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।

প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তে এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে বলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন।

এ নির্দেশনার ফলে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত যেসব ব্যক্তি বা আসামি এতদিন ফেরারি জীবনযাপন করছিলেন, তারা আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে পারবেন বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোভিড-১৯ এর কারণে আমাদের দেশের আদালতগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। ভার্চুয়ালি কিছু বিষয়ে বিচারিক কাজ চলছে। আজকের এই নির্দেশনার ফলে ফৌজদারি মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিদের যে বিচার পাওয়ার অধিকার সেটি প্রতিষ্ঠিত হল।

“কারণ একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে বিচার চাইতে পারেন, জামিন চাইতে পারেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে এটা না থাকার কারণে তাদের হয়ত পলাতক থাকতে হচ্ছিল। এখন তারা আদালতে হাজির হয়ে বিচারের প্রার্থনা করতে পারবেন, জামিন চাইতে পারবেন।” 

সুপ্রিম কোর্টে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান মনে করছেন, এই নির্দেশনার ফলে শুধু আইনি অধিকার নয়, সংকটকালীন পরিস্থিতিতে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনি সুরক্ষাও নিশ্চিত হয়েছে। 

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ নির্দেশনার ফলে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও সশরীরে আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে পারবেন। এতদিন যেটা তারা পারছিলেন না। আদালতও আত্মসমর্পণটা নিচ্ছিল না। কারণ ভার্চুয়াল কোর্টে আত্মসমর্প হয় না। ভার্চুয়াল হাই কোর্টও আত্মসমর্পণ নিচ্ছে না।

“কাজেই এ নির্দেশনায় সবচেয়ে উপকৃত হবে ফৌজদারি মামলার যারা আসামি বা যারা আত্মসমর্পণ করার সুযোগ না পেয়ে ফেরারি আছেন তারা। তাদের জন্য ন্যায়বিচারের একটি নিশ্চয়তা তৈরি হল। তারা এখন আত্মসমর্পণ করে জামিনও চাইতে পারবেন।”     

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে গত ১১ মে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করে ফৌজদারি মামলার আসমিদের জামিন আবেদনের শুনানি, নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়। সে কোর্ট কীভাবে পরিচালিত হবে তার জন্য প্র্যাকটিস নির্দেশনাও জারি করা হয় সুপ্রিম কোর্ট থেকে।

সারা দেশে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু হওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট ৩৫ কার্যদিবসে অধস্তন আদালত থেকে বিভিন্ন মামলার ৪৯ হাজার ৭৬২ জন আসামির জামিন হয়েছে বলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জানিয়েছেন।

শনিবার রাতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়, “উপরোক্ত বিষয়ে নির্দেশিত হয়ে জানানো যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিগণের সাথে আলোচনাক্রমে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত স্বাস্থ্যবিধি এবং শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে অনুসরণ করে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি/ব্যক্তিগণ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পারবেন।

“এতদবিষয়ে বিজ্ঞ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট/দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট এজলাস কক্ষে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনসহ শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বজায় নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করবেন।”

আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া কেমন হবে, তাও উল্লেখ করা হয়েছে নির্দেশনায়। 

বলা হয়েছে, “চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট/সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ আবেদন দাখিল এবং শুনানি কার্যক্রমের পদ্ধতি ও সময়সূচি এমনভাবে নির্ধারণ ও সমন্বয় করতে হবে যাতে আদালত প্রাঙ্গণে এবং আদালত ভবনে কোনো রূপ জনসমাগম না ঘটে।

“আদালত প্রাঙ্গণে এবং এজলাস কক্ষে প্রত্যেককে কমপক্ষে ছয় ফুট শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে এবং সকল প্রকার জনসমাগম পরিহার করতে হবে।”

জনসমাগম এড়াতে মূখ্য বিচারিক হাকিম এবং মুখ্য মহানগর বিচারিক হাকিমকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক আবেদন বা দরখাস্ত শুনানি করতে বলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দশনায়।

তার জন্য আবেদন বা দরখাস্ত শুনানির তালিকা আদালত ও আইনজীবী সমিতির নোটিশ বোর্ডে দিয়ে প্রচারের ব্যবস্থাও নিতে বলা হয়েছে।

নির্দেশনায় বলা হয়েছে, “একটি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে সর্বোচ্চ দুইজন বিজ্ঞ আইনজীবী শুনানিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।এজলাস কক্ষে একত্রে ছয়জনের অধিক লোকের সমাগম করা যাবে না।

“তবে একই মামলায় একাধিক আত্মসমর্পণকারী অভিযুক্ত ব্যক্তি থাকলে এজলাস কক্ষের ডকে সর্বোচ্চ পাঁচজন অভিযুক্ত ব্যক্তি অবস্থান করতে পারবেন।”

এক্ষেত্রে বিচারিক হাকিমদের কয়েক ভাগে মামলা শুনানির এখতিয়ার দিয়ে নির্দেশনায় বলা হয়েছে, “মামলা শুনানির সময় এজলাস কক্ষের বাইরে আদালতের বারান্দায় বা করিডোরে জনসমাগম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।”

নির্দেশনায় আরও বলা হয়, আত্মসমর্পণ দরখাস্ত শুনানির সময় অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং তার পক্ষের আইনজীবী ছাড়া অন্য কোনো আইনজীবী এজলাস কক্ষে অবস্থান করবেন না।

একটি আত্মসমর্পণ দরখাস্ত বা শুনানি শেষে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী এজলাস কক্ষ ত্যাগ করার পর ম্যাজিস্ট্রেট পরবর্তী আসমর্পণের দরখাস্ত শুনানির জন্য গ্রহণ করবেন।

এজলাস কক্ষে প্রত্যেককে আবশ্যিকভাবে মাস্ক পরতে হবে। আদালতে প্রবেশের সময় প্রত্যেকের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষার ব্যবস্থাও নিতে বলা হয়েছে।

“এজলাস কক্ষে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনসহ শারীরিক দূরত্ব কঠোরভাবে বজায় নিশ্চিত করণার্থে তৎক্ষণিক যে কোনো পরিস্থিতি বিবেচনায় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজনবোধে আত্মসমর্পণ দরখাস্ত শুনানি করা হতে বিরত থাকাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।”

এ প্রক্রিয়ায় আদালতের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় আইনজীবীদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে নির্দেশনায়।

স্বাস্থ্যবিধি, শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে কি না সে বিষয়ে প্রতি সপ্তাহে মুখ্য বিচারিক হাকিম এবং মুখ্য মহানগর বিচারিক হাকিমদের সুপ্রিম কোর্টকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।