‘চাহিদা কমায়’ বন্ধ মহামারীর ত্রাণ, যাচ্ছে বন্যার এলাকায়

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর চার মাসের মাথায় জনজীবন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকটা সচল হওয়ায় কর্মহীন মানুষের জন্য ত্রাণের চাহিদা ‘কমে গেছে’ বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলাম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2020, 09:59 AM
Updated : 2 July 2020, 11:33 AM

বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মাঠ পর্যায়ে চাহিদা না থাকায় গত ১৫ জুন থেকে আর ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না। এখন বন্যাদুর্গত জেলাগুলোতে ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে।”

মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তরা বলছেন, সীমিত পরিসরে অফিস ও গণপরিবহন চালু, দোকানপাট ও শপিংমল খোলা রাখার সময় বাড়ানো, নতুন ধান ঘরে ওঠার পাশাপাশি বিধিনিষেধ শিথিল করায় ত্রাণের চাহিদা আপাতত কমেছে।

তাই মহামারী পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমজীবী মানুষ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাৎক্ষণিক মানবিক সহায়তা হিসেবে বিতরণের জন্য সরকারিভাবে আর ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করনোভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ২৬ মার্চ থেকে অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষণা করে টানা ৬৬ দিন ‘সাধারণ ছুটি’ চলে।

ওই সময়ে কর্মহীন ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিতরণ করতে মার্চ মাসের শেষ থেকে ধারবাহিকভাবে নগদ টাকা এবং চাল ত্রাণ হিসেবে বরাদ্দ দিয়ে আসছিল সরকার।

গত ১১ জুন সবশেষ ত্রাণ সামগ্রী বরাদ্দ দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ওইদিন পর্যন্ত মানবিক সহায়তা হিসেবে মোট দুই লাখ ১১ হাজার ১৭ মেট্রিক টন চাল এবং ১২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, “এখন আর ত্রাণের কোনো চাহিদা নেই। আমরা যে ত্রাণ দিয়েছি তার মধ্য থেকে এখনও মজুদ আছে বলে জেলা প্রশাসকরা রিপোর্ট দিয়েছেন।

“নিম্ন আয়ের মানুষ যাদের ত্রাণের দরকার ছিল তারা কাজে ফিরে গেছেন, এখন উপার্জন করতে পারছেন। নতুন ধান উঠেছে, আম উঠেছে, খাদ্য সঙ্কটটা আর নেই, যার ফলে ত্রাণের চাহিদাও নেই। চাহিদা না থাকায় ১৫ জুন থেকে ত্রাণ দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে।”

তবে কেউ বরাদ্দ চাইলে ত্রাণ দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, করোনাভাইরাস সঙ্কটের জন্য আরও দুই লাখ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চাহিদা দিয়ে রাখা হয়েছে।

আপাতত শুধু বন্যাদুর্গত জেলাগুলোতে ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, নয় জেলায় নতুন করে ১০০ মেট্রিক টন করে চাল এবং ‘এ’ ক্যাটাগরির জেলায় ১০ লাখ এবং ‘বি’ ক্যাটাগরির জেলায় পাঁচ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে।

“বন্যার সময় যদি ত্রাণ বিতরণ করতে হয় সেই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। জুলাইয়ের শেষ থেকে অগাস্টের দ্বিতীয়-তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দীর্ঘাস্থায়ী বন্যা হবে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। এজন্য সেজন্য শুকনো খাবার, শিশু খাদ্য, নগদ টাকা মজুদ রাখা হয়েছে। আরও শুকনো খাবার কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।”

মহামারীর মধ্যে ত্রাণের চাহিদা কমার তথ্য পাওয়া গেছে কয়েকজন জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছ থেকেও। তবে এক মাস পার আবার চাহিদা তৈরি হবে বলে মনে করছেন তাদের কেউ কেউ।

লালমনিরহাটের ডিসি মো. আবু জাফর বলেন, তার জেলায় এই মুহূর্তে ত্রাণের কোনো চাহিদা নেই। তাদের হাতে এখনও ৬৩০ মেট্রিক টন চাল এবং ৩০ লাখ টাকা মজুদ রয়েছে।

‘৩৩৩’ নম্বর বা স্থানীয় প্রশাসনে ত্রাণ চেয়ে এখন ফোন আসছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আগের মত আর ফোনও আসছে না।

“ট্রান্সপোর্ট খুলে দিয়েছে, মানুষ ব্যবসা করতে পারছে, কাজ করতে পারছে, ঘরে নতুন ধান উঠেছে। ফলে খাবারের চাহিদাটা নেই। এরপরেও কেউ যদি ত্রাণ সহায়তা চায় তাদের তা দেওয়া হবে।”

এ জেলায় বন্যা দুর্গতদের মধ্যে ১৩০ মেট্রিক টন চাল এবং ১৫ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে জানিয়ে আবু জাফর জানান, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে পাওয়া বরাদ্দ ছাড়াও গতবারের বন্যার সময় পাওয়া কিছু চাল ও নগদ টাকা এখনও তাদের হাতে রয়েছে।

চাহিদা কমলেও রাজবাড়ীতে এখনও ত্রাণের চাহিদা রয়েছে বলে এই জেলার ডিসি দিলসাদ বেগম জানিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, “কারোনা শুরুর পর সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট ত্রাণ দেওয়া হয়েছে, আমরা প্রান্তিক পর্যায় থেকেও দিয়েছি।

“ত্রাণের চাহিদা আসলে থাকছেই, কারণ যাকে একবার ত্রাণ দিয়েছি দুই মাস হয়ে গেলে সে তো আবারও ত্রাণ চায়।”

মন্ত্রণালয় থেকে যেসব ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল তা ৩০ জুন পর্যন্ত খরচ করা হয়েছে জানিয়ে ডিসি দিলসাদ বলেন, “সে কারণে আমরা আর চাহিদা পাঠাইনি। সরকার থেকে যথেষ্ট ত্রাণ পেয়েছিলাম, তবে এই মাসে নতুন করে চাহিদা তৈরি হবে। এখন মানুষজন কাজ করতে পারছে, রাজবাড়ী কৃষি নির্ভর হওয়ায় ত্রাণের চাহিদা কমেছে।”

হবিগঞ্জেও ত্রাণের চাহিদা কমার তথ্য দিয়েছেন ডিসি মোহাম্মদ কামরুল হাসান। তিনি জানান, ৩৩৩ নম্বরে ত্রাণের জন্য এখনও ফোন আসছে। তবে আগে যেখানে দিনে ১০০-১৫০ ফোন আসত, এখন আসছে ৫-৭টি কল।

“ত্রাণের চাহিদা আপাতত কমে গেছে। ফসল উঠেছে, দোকানপাট খোলায় নিজেই নিজেরটা আয় করতে পারছে। তবে আমার ধারণা, মাসখানেক পরে ত্রাণের চাহিদা আবার তৈরি হবে।”

৩৩৩ নম্বরে ত্রাণ চেয়ে কেউ ফোন করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বলে জানান কামরুল।

এর আগে বরাদ্দ দেওয়া ত্রাণ এখনও বিতরণ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আরও ১০/১৫ দিন তা বিতরণ করা যাবে।

হবিগঞ্জে একেকটি পরিবারকে পাঁচটি করে বড় আকারের হাঁস দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে ডিসি বলেন, “বুধবার ৫০০ হাঁস বিতরণ করেছি। ওগুলো এক মাসের মধ্যে ডিম দেবে। এই সপ্তাহের মধ্যে আরও পাঁচ হাজার হাঁস দেব। নরসুন্দররা মাসে ১০ দিন করে সেলুন বন্ধ রাখবে, এজন্য তাদের সবাইকে চাল, ডাল, তেল, আলু দেওয়া হচ্ছে।”

ত্রাণ পেয়েছে দেড় কোটি পরিবার

করোনাভাইরাস সঙ্কটে মানবিক সহায়তা হিসেবে এ পর্যন্ত সারা দেশে দেড় কোটির বেশি পরিবারকে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।

ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলছে, ২৯ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ত্রাণ হিসেবে দুই লাখ ১১ হাজার ১৭ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে এক লাখ ৮৯ হাজার ১৮২ মেট্রিক টন। এতে এক কোটি ৬৩ লাখ ২৮ হাজার ১৫১টি পরিবারের সাত কোটি ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৮৮৯ জন উপকারভোগী।

এছাড়া ত্রাণ হিসেবে নগদ ৯৫ কোটি ৮৩ লাখ ৭২ হাজার ২৬৪ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ৮৮ কোটি ৮০ লাখ ৭২ হাজার ২৬৪ টাকা। নগদ টাকার উপকারভোগী ৯৭ লাখ ৩৯ হাজার ৪৯২ পরিবারের চার কোটি ৩০ লাখ ৪ হাজার ৫১৩ জন।

শিশু খাদ্য কিনতে নগদ ২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও ২৫ কোটি ৪০ লাখ ১৯ হাজার ২৪১ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এতে ৮ লাখ ১৮ হাজার ৩২৯টি পরিবারের উপকারভোগীর সংখ্যা ১৭ লাখ ৮ হাজার ৬১৬ জন।