খাবারের বিল বিতর্ক: খরচের হিসাব দিল ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনাভাইরাস চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীদের খাবারের বিল নিয়ে বিতর্কের মধ্যে কোন খাতে কত খরচ তার ফর্দ দিলেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2020, 11:50 AM
Updated : 1 July 2020, 12:12 PM

তিনি বলেছেন, খাবারের জন্য জনপ্রতি ৫০০ টাকা করে নির্ধারণ করা আছে। খরচের বড় অংশ যাচ্ছে হোটেল ভাড়ায়। ২ হাজার ২৭৬ জন স্বাস্থ্যকর্মীর এক মাসের থাকা ও খাওয়া বাবদ খরচ হয়েছে সাড়ে ১৩ কোটি টাকার বেশি। দুই মাসে তা ২৭ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।

এক মাসে ২০ কোটি টাকা খাবারের বিলের যে খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব কথা হচ্ছে, সেসব ‘ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।  

করোনাভাইরাস চিকিৎসায় নিয়োজিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীদের ‘এক মাসের খাবারের বিল’ ২০ কোটি টাকা আসার ওই খবর কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে এলে আলোচনা শুরু হয়।

বিষয়টি সংসদ অধিবেশনে উঠলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গত সোমবার এ নিয়ে কথা বলেন। এক মাসের খাবারের বিল ২০ কোটি টাকা কী করে হয়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এই বিতর্কের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে এর ব্যাখ্যা দিতে বুধবার হাসপাতালে এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন।

তিনি বলেন, চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুই মাসের থাকা, খাওয়া ও যাতায়াত বাবদ কী পরিমাণ খরচ হতে পারে তা মন্ত্রণালয় থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী, জুনের শুরুর দিকে তারা একটি বাজেট দিয়েছিলেন। সেখানে বলা হয়েছিল, দুই মাসে ২০ কোটি টাকার মত লাগতে পারে।

“কিন্তু গণমাধমে বলা হচ্ছে শুধু খাবার খরচ বাবদ এত টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। প্রথম আমরা দেখেছি, ২০ কোটি টাকা শুধু চিকিৎসকের খাবারের জন্য লেখা হয়েছে। কথা হচ্ছে, এখানে শুধু চিকিৎসক নয়, এখানে কর্মকর্তা কর্মচারী, নার্সরা রয়েছেন, মোট ৩ হাজার ৬৮৮ জন গত দুই মাসে কাজ করছেন।”

ওই খবরকে কেন ‘বানোয়াট বা মিথ্যা’- সেই ব্যাখ্যা দিয়ে মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, “২০ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হলেও দুই মাসে ২৬ কোটি টাকার বেশি খরচ হবে। এই খরচ সবার জন্য, কিন্তু খবরে এল বিশ কোটি টাকা দুইশ চিকিৎসকের এক মাসের খাবারের খরচ।”

কীভাবে এত খরচ

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত ২ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগকে ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতাল হিসেবে রূপান্তর করে রোগী ভর্তি শুরু হয়। সেখানে ২৫০ জন রোগী ভর্তির ব্যবস্থা রয়েছে এবং ১০টি আইসিইউ ও ২০টি কেবিনের ব্যবস্থা রয়েছে।

পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ১০ তলা ভবনটি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতাল হিসেবে রূপান্তর করার নির্দেশ দেয়।

বর্তমানে সেখানে ৬০০ রোগী ভর্তি রয়েছে এবং ২ মে থেকে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৯০৪ জন কোভিড-১৯ রোগী এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মারা গেছেন ২১০ জন, সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৫৮০ জন।

হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘এই বিশাল কর্মযজ্ঞ’ পরিচালনা করার জন্য চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের ৩০টি হোটেলে থাকা, খাওয়া এবং যাতায়াতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হচ্ছে।

“দুই ইউনিট মিলে প্রতি তিন সপ্তাহে প্রায় এক হাজার ৮৯৪ জন কর্মকর্তা, কর্মচারীকে হোটেলে রেখে থাকা, খাওয়া এবং যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।”

কোয়ারেন্টিন নীতিমালা অনুযায়ী ৭ দিন কর্তব্যকালীন সময় হোটেলে অবস্থানসহ পরবর্তী ১৪ দিন হোটেলে কোয়ারেন্টিন এবং পরবর্তী ৭দিন বাসায় বিশ্রামে থাকার নির্দেশনা রয়েছে।

ক্যাটাগরি অনুযায়ী যেসব হোটেলে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে, সেগুলোর নামও সংবাদ সম্মেলনে বলেন পরিচালক।

হোটেলগুলো হল-  হোটেল শালিমার ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল ওসমানী ইন্টারন্যাশনাল, সুন্দরবন হোটেল, হোটেল মেলোডি ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল ডিলাক্স ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল ফারুক ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল ইনসাফ ইন্টারন্যাশনাল, বিসমিল্লাহ হোটেল অ্যান্ড  রেস্টুরেন্ট (শুধু খাবার), হোটেল স্টার সিটি ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল রাহমানিয়া ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল আল ফারুক, হোটেল মুনা, লেকশোর সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড, হোটেল গ্রীন ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, হোটেল নিউ ইয়ার্ক, হোটেল-৭১, হোটেল গিভেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল গোল্ডেন টিউলিপ দ্যা ল্যান্ডমার্ক, হোটেল সেন্টার পয়েন্ট, হোটেল অ্যান্ড সাফারি, হোটেল লা-ভিঞ্চি, ইন্নোটেল লাক্সারি হোটেল, হোটেল দি রাহমানিয়া ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল স্প্রিং হিল, হোটেল আসিয়ানা, হোটেল পিনাকল ইনু, হোটেল দি ক্যাপিটাল লিমিটেড, লা ভিলা ওয়েস্টিন ও ডেইজি হোটেল।

এক প্রশ্নের জবাবে নাসির উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, হোটেল নির্ধারণের জন্য তাদের চার সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে।

“যখন বলা হয় এই হোটেলে চিকিৎসক আর এই হোটেলে নার্স ও এই হোটেলে কর্মচারী রাখতে পারবেন, এই কমিটির সদস্যরা তা ঠিক করেন। হোটেলগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দর কাষাকষির মাধ্যমে ভাড়া ঠিক করা হয়েছে, কোনো কোনো হোটেলে ৫০ শতাংশ বা ৩০ শতাংশও রাখছে।

“সব হোটেল কর্তপক্ষকে জানানো হয়েছে, খাবারে জনপ্রতি প্রতিদিন ৫০০ টাকা এবং থাকা বাবদ কত নেবেন- এভাবেই দর কাষাকষি করে ঠিক করা হয়েছে।”

সব হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তিপত্র করা হয়েছে এবং তা মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি। 

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ২ মে থেকে এক হাজার ২৫৮ জন চিকিৎসক, এক হাজার ৫৬৭ জন নার্স, ৫০ জন টেকনোলজিস্ট, ১৬ জন ফার্মসিস্ট, ৪৪৩ জন কর্মচারী এবং ৩৫৪ জন আনসার দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সংখ্যাও হাসপাতালের রোগীর তুলনায় ‘অপ্রতুল’।

“প্রায় ২ হাজার ২৭৬ জন স্বাস্থ্যকর্মীর এক মাসের হোটেলে থাকা ও খাওয়া বাবদ খরচ হচ্ছে ১১ কোটি ৮৬ লাখ ৩১ হাজার ২৫০ টাকা। ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ যা দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৬৪ লাখ ২৫ হাজার ৯৩৭ টাকায়।

“সমসংখ্যক লোকের যাতায়াত বাবদ ১০টি ১২ আসনের এসি মাইক্রোবাস, একটি ১৫ আসনের এসি মাইক্রোবাস, একটি ২৬ আসনের এটি টুরিস্ট কোচ, দুটি ৪৫ আসনের নন এসি বড় বাস ভাড়া করা হয়েছে।”

লকডাউন চলাকালে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় হাসপাতালের বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর আনা-নেওয়ার জন্য বিটিআরসির চারটি দ্বিতল বাসও ভাড়া করা হয়েছিল বলে জানান পরিচালক।

তিনি বলেন, ইতোপূর্বে এক মাসের খরচ হিসেব করে সেই আলোকে দুই মাসের ব্যয় নির্বাহের জন্য ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিলেন তারা।

‘ডাক্তার সমাজকে আঘাত’

মেডিসিনের অধ্যাপক মোহাম্মদ বিল্লাল আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “গতকাল সংসদে বলা হয়েছে, একটি ডিম এক হাজার টাকা, দুই পিস পাউরুটির দাম পাঁচশ কি এক হাজার টাকা… এই জিনিসগুলো আমাদের ডাক্তার সমাজকে খুব আঘাত করেছে।

“আপনারা শুনলেন, একজন চিকিৎসকের দৈনিক খাবার খরচ ৫০০ টাকা। তাহলে দেখেন এই মহামারীর পরিস্থিতিতে যেখানে বাবা অসুস্থ্ হলে মা যায় না, মা অসুস্থ হলে মা যায় না, স্বামী অসুস্থ হলে স্ত্রী যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে ডাক্তাররা যেভাবে ডিউটি করছে, তার ওপর মিডিয়াতে যদি এ রকম নিউজ করা হয়, তাহলে মনটা ভেঙে যায়। … এজন্য সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা।”

ওই খবরের প্রচারে সামাজিকভাবে অপদস্ত হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমার চার সন্তান, দুই জন চিকিৎসক হয়েছে, আর দুজন মেডিকেলে পড়াশোনা করছে। তারাও আমার কাছে বলে, ‘তোমরা এত খাও, এক ডিম এক হাজার টাকা করে খাও!’ এ ধরনের প্রশ্ন কিন্তু সবাই করছে।”

এ পর্যন্ত হাসপাতালের ১০৩ জন চিকিৎসক, ২৮৭ নার্সিং কর্মকর্তা, ২১ জন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, ৪৬ জন চতূর্থ শ্রেণির কর্মচারী এবং ১০ জন আনসার সদস্য কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।