মহামারীর দিনে বাড়ছে বাল্যবিয়ে

দেশের আর্থ সামাজিক ব্যবস্থায় করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাব উঠে এসেছে এক জরিপে; যাতে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে বাল্যবিয়ে গেছে বেড়ে।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 June 2020, 08:19 PM
Updated : 26 June 2020, 03:59 AM

নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোও বলছে, বাল্যবিয়ের তথ্য নিয়মিতই তাদের কাছে আসছে। আর তা আগের চেয়ে বেশি।

এর বিপরীতে বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রশাসনের তৎপরতা কমে আসার তথ্য দিয়ে নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, এ পরিস্থিতি চললে তা উদ্বেগজনক হয়ে উঠবে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি বিভাগের এক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ১৩ শতাংশ করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে তাদের এলাকায় বাল্যবিয়ে হয়েছে বলে জানিয়েছেন।

সংস্থাটির ১১টি জেলার ৫৫৭ জন সাক্ষাৎকারদাতার ৭২ জন এই সময়ে ৭৩টি বাল্যবিয়ের ঘটনা দেখেছেন।

এসব বাল্যবিয়ের ৮৫ শতাংশই হয়েছে সঙ্কটকালে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণে। ৭১ শতাংশ বিয়ে হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায়।

করোনাভাইরাস সঙ্কটে বিদেশ থেকে ফেরত আসা পাত্র পাওয়ায় ৬২ শতাংশ শিশুর পরিবার বিয়ে দিতে আগ্রহী হয়েছে।

৬১ শতাংশে বিয়ে হয়েছে অভিভাবকের সীমিত উপার্জনের কারণে পরিবার চালানোয় হিমশিম খাওয়ায়।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিদেশ ফেরতদের কাছে অভিভাবকরা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া অনেক বাবা-মা মনে করছেন, এ পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদী হবে এবং তারা সন্তানদের খাবার জোগাতে পারবেন না।”

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না মনে করে অভিভাবকরা বাল্যবিয়ের জন্য এ সময়কে বেছে নিয়েছেন।

কুড়িগ্রামে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে কাজ করছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।

সংস্থাটির শেষ চার মাসের বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত জরিপে দেখা যায়, জেলাটিতে ফেব্রুয়ারিতে ৫১৯টি বিয়ের ৪০টি, মার্চে ৩৭৬টি বিয়ের ২৯টি, এপ্রিলে ২০৫টি বিয়ের ১৯টি এবং মে মাসে ৩০৩টি বিয়ের ৩৩টি ছিল বাল্যবিয়ে।

সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “করোনাভাইরাস পরিস্থিতি যত দীর্ঘ হচ্ছে, ততই মোট বিয়ের বিপরীতে বাল্যবিয়ে বেড়ে যাচ্ছে।”

এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে বাল্যবিয়ে হয় ৮ শতাংশ, যা এপ্রিলে ৯ শতাংশে দাঁড়ায়। মে মাসে তা আরও বেড়ে হয় ১১ শতাংশ।

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে তৎপরতা কমে আসার কথাও বলা হয় প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে ১৪টি, মার্চে ১০টি, এপ্রিলে ৩টি ও মে মাসে ২টি বাল্যবিয়ে ঠেকানো গেছে।

এসময়ে অনিবন্ধিত বিয়েও বেড়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসে ৮ শতাংশ, মার্চে ৯ শতাংশ, এপ্রিলে ১০ শতাংশ ও মে মাসে ১১ শতাংশ অনিবন্ধিত বিয়ের ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি তৎপরতায় বাল্যবিয়ে ও অনিবন্ধিত বিয়ে কমে এসেছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে।

মহামারীর কারণে সৃষ্ট নতুন বাস্তবতায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কার্যক্রম কমে যাওয়ার পাশাপাশি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে গঠিত সংস্থাটির যুব ফোরামগুলোও অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনার কারণে বাল্যবিয়ের মনিটরিং একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে। গত তিন মাসে কুড়িগ্রামে জেলা বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক একবারও হয়নি।

“করোনার কারণে আমাদের যুব ফোরামও আগের মত প্রতিরোধ করতে পারছে না। কারণ তারা কাজটি করে ইউএনও ও পুলিশের সহায়তা নিয়ে।”

অনিবন্ধিত বিয়েগুলোর অধিকাংশই বাল্যবিয়ে বলে জানান তিনি।

বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার পিছনে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার প্রসঙ্গ টেনে নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “কুড়িগ্রামে ১০ হাজার পরিবারকে আমরা বাল্যবিয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, এর মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার পরিবার অতি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব পরিবারের অভিভাবকরা তার যেকোন সময় বাল্যবিয়ে দিয়ে দিতে পারে।

“বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হলে এসব পরিবারের সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখতে হবে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে। অর্থনৈতিক সংকটে তাদের সহযোগিতা করতে হবে।”

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন নারী অধিকার কর্মীরাও।

বেসরকারি সংস্থা নিজেরা করি'র সমন্বয়কারী ও মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির জানান, করোনাভাইরাসের কারণে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা না গেলেও তাদের হটলাইনে বাল্যবিয়ের অনেক অভিযোগ পেয়েছেন তারা।

“বাল্যবিয়েতে যৌতুক কম লাগে, মা-বাবার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়, এসব কারণেই বাল্যবিয়ে হয়ে থাকে।”

তিনি বলেন, “আগে বিয়ে হলে আত্মীয়, প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণের ব্যাপার ছিল। বিয়ের আয়োজন হলে সেটার খবর পাওয়া যেত। এখন করোনাভাইরাসের কারণে বাবা-মা'রা লুকিয়ে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।

“প্রশাসন ও কাজীরাও আগে বাল্যবিয়ে বন্ধে ভালো ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এখন সেটা কমে এসেছে। বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করলেও সরকারের কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।”

খুশি কবির আরও বলেন, “স্কুল থেকে আগে বাল্যবিয়ের তথ্য পাওয়া যেত, কেউ স্কুলে না আসলে তার বন্ধুরা বিষয়টি শিক্ষকদের জানাত। প্রশাসনও উদ্যোগী হয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধ করত। কিন্তু এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ। ফলে অগোচরে অনেক মেয়ের বাল্যবিয়ে হয়ে যাচ্ছে।”

বাল্যবিয়ে বন্ধে সরকারকে জোরেশোরে প্রচারের তাগিদ দিয়েছেন এই মানবাধিকার কর্মী।

“সরকার সামাজিক দূরত্ব মেনেই মাইকিং করতে পারে। এতে সচেতনতা বাড়বে। আসলে আমরা নিজেরা যদি সচেতন না হই, তাহলে তো হবে না। মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি।

“মেম্বার, চেয়ারম্যানরা দরিদ্রদের সাহায্যের টাকা লুটপাটে ব্যস্ত থাকে, অথচ মানুষের সেবায় এগিয়ে আসে না। তারা চাইলেই বাল্যবিয়ে বন্ধ সম্ভব। যে যার এলাকায় যদি চেষ্টা করে, তাহলে কিন্তু একটা বাল্যবিয়েও হবে না", বলেন খুশি কবির।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু মনে করেন, এ সময়টায় বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকা। পড়াশুনা বন্ধ থাকায় অভিভাবকরা বাল্যবিয়ে দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

“এ সময়টাতেও মেয়ে শিশুদের উপবৃত্তি কার্যক্রম যেন বন্ধ না হয়। আর গ্রামগঞ্জেও অনলাইনে ক্লাস নেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।"

অভিযোগ পেয়ে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৭ থেকে ৮টি বাল্যবিয়ে প্রশাসনের সহায়তায় মহিলা পরিষদ বন্ধ করেছে বলে জানান তিনি।

মহামারীর এ সময়ে সরকারি তৎপরতা না বাড়ালে বাল্যবিয়ে ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে, মনে করেন তিনি।

"সরকারকে প্রচার চালাতে হবে। ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে। না হলে বাল্যবিয়ে বেড়ে গেলে জাতীয় উন্নয়নে এর বড় প্রভাব পড়বে।"

মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরার সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কথা বলবেন বলে জানানো হলেও এরপর তিনি আর ফোন ধরেননি।

মন্ত্রণালয়টির সচিব কাজী রওশন আক্তারের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।