বয়সের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা বাড়ছে, এটাই অর্জন: সিরাজুল ইসলাম

জীবন সায়াহ্নে এসে চাওয়া-পাওয়ার কোনো হিসাব মেলাতে চাননা সময়ের লড়াকু বুদ্ধিজীবী, বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বরং যতটুকু অর্জন, তাতেই আছে সন্তুষ্টি।

রাসেল সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 June 2020, 08:36 AM
Updated : 23 June 2020, 10:04 AM

মঙ্গলবার ৮৫তম জন্মদিনে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিজের উপলব্ধির কথা বললেন এভাবে- “আমি যা করেছি বা যা পেয়েছি, জীবনের কোনো কিছু নিয়ে ক্ষোভ নেই। হয়ত গুণগতভাবে আরও ভালো কিছু করতে পারতাম। হয়তো ভালো পদে যেতে পারতাম। জীবনের চাওয়া পাওয়া নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। লেখালেখি করা, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যোগদান করতে পেরেছি, এটাই আমার বড় অর্জন।”

জন্মদিনের অনুভূতি ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “জীবনের এই পর্যায়ে এসে দুই ধরনের অনুভূতি হচ্ছে। এক বয়স বেড়েছে, অন্যদিকে আমার দৃষ্টিভঙ্গি আরও স্বচ্ছ হচ্ছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে এখনও দেশ ও শিক্ষা-ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে পারছি। দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা বাড়ছে, এটাই বড় অর্জন। এই সময়টাতে যে জিনিসটা হয়, আপনজনদের খুব মনে পড়ছে, স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করি এই সময়টাতে। অন্য কোনো ব্যাপারে কোনো দুঃখ নেই।”

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম বলেন, “এখন পুরো বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটছে। সারা বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থাই ক্ষতির মুখে পড়েছে, শুধু আমাদেরই ক্ষতি হচ্ছে না।

“তবে এখন তো পড়ালেখা করার ভালো সুযোগ। অভিভাবকদের তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে বাসায় পড়ালেখায় ব্যস্ত রাখা উচিত, যাতে সময়টার সদ্ব্যবহার হয়। এই সময়টাতে পড়ালেখায় এগিয়ে থাকলে পরে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা কিছু রিকভার করা যাবে।”

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

মহামারীর এই সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে নিজের মতামত তুলে ধরে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “আমরা যেটা জানতে পেরেছি, অনলাইনে ক্লাস করার জন্য সকল শিক্ষার্থীর সক্ষমতা নেই। লেখাপড়াটা আসলে অশরীরী হয় না, লেখাপড়া শিখতে হয় একটি সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এজন্য ক্লাস রুম প্রয়োজন হয়, শিক্ষকের দরকার হয় এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগ দরকার হয়।”

মানব সভ্যতা অনেক এগোলেও করোনাভাইরাস মানুষের স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

“সাধারণ মানুষের কোনো নিরাপত্তা নাই। সর্বত্র দুর্নীতি ও অনিয়ম দেখা যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে। আমাদের দেশেও কিছু মানুষ অতি ধনী হচ্ছে, কিছু মানুষ আতি দরিদ্র হচ্ছে। আজীবন সাম্যবাদী দর্শন চর্চা করেছি। আজীবন বিরাজমান নিপীড়ক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে গেছি। মানুষের মুক্তির জন্য, সমাজ ব্যবস্থাকে বদলানোর স্বার্থেই লড়েছি। এখনও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, মানুষের মুক্তি মেলেনি।”

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন মুন্সিগঞ্জ (পূর্বনকম বিক্রমপুর ) জেলার শ্রীনগর উপজেলার বাড়ৈখালী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, নটরডেম কলেজ,এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে । ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের লিডস এবং লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৫৭ সালে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট কর্তৃক দুবার উপাচার্য হওয়ার জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় তিনি মাসিক পরিক্রমা (১৯৬০-৬২), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা (১৯৭২), ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র (১৯৮৪) ইত্যাদি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন, বর্তমানে তিনি ‘নতুন দিগন্ত’ নামে সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার কাজ করেছেন।

প্রবন্ধ, অনুবাদ ও কথাসাহিত্য মিলিয়ে তার রচিত বই প্রায় ১১০টি। তার লেখা উল্লেখযোগ্য বই- 'বঙ্কিমচন্দ্রের জমিদার ও কৃষক', 'বাঙালীর জাতীয়তাবাদ', 'জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি :১৯০৫-৪৭', 'দুই যাত্রায় এক যাত্রী', 'ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ', 'দ্বি-জাতিতত্ত্বের সত্য-মিথ্যা' ও 'নজরুলকে চিনতে চাওয়া'।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাহিত্যকর্মে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘বাংলা একাডেমি স্বর্ণপদক’, ‘বিচারপতি ইব্রাহিম পুরস্কার’, ‘অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার’, ‘বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবুল্লাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার’ সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।