টেলিভিশন ক্লাসের বাইরে ৫৬% শিক্ষার্থী: জরিপ

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ওপর এই ভাইরাসের বড় রকমের প্রভাব পড়ার চিত্র উঠে এসেছে ব্র্যাকের এক জরিপে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 June 2020, 05:33 PM
Updated : 20 June 2020, 06:39 PM

শনিবার প্রকাশিত ওই জরিপে বলা হয়, সংসদ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ক্লাস অধিকাংশ প্রাথমিক-মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করতে পারেনি। ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনের ক্লাসে অংশ নেয়নি।

দুরশিক্ষণে যারা অংশ নিচ্ছে না, তাদের ৭১ শতাংশ বলেছে বাড়িতে টিভি, বিদ্যুৎ নেই, কেবল লাইন কিংবা ইন্টারনেট নেই। তাদের মধ্যে ২১ ভাগ শিক্ষার্থী জানেই না এ ধরনের একটা ব্যবস্থা আছে।

এদিকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের এই সময়ে নানা কারণে শতকরা ১৬ ভাগ শিক্ষার্থী ‘উদ্বেগ ও আতঙ্কে’ ভুগছে বলে জরিপে বলা হয়েছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার কারণে অনেকের মধ্যে পড়ালেখার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠার প্রবণতাও দেখা গেছে এই জরিপে।

জরিপে আরও দেখা যায়, টেলিভিশন, ইন্টারনেট বা বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যা ইত্যাদি বিবিধ কারণে অনেক শিক্ষার্থী করোনাকালীন দূরশিক্ষণে অংশ নিতে পারছে না।

বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের ১০ দিনের মাথায় ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

পরে ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সব অফিস-আদালত আর যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে শুরু হয় ‘লকডাউন’।

দুই মাস পর ৩১ মে থেকে সীমিত পরিসরে অফিস খুলে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হয়েছে ৬ অগাস্ট পর্যন্ত।

এর মধ্যে মে মাসের ৪-৭ তারিখে দেশের আট বিভাগের ১৬টি জেলায় ব্র্যাক পরিচালিত জরিপে অংশ নিয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১ হাজার ৯৩৮ শিক্ষার্থী।

একইসঙ্গে জরিপের অংশ হিসাবে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে বিস্তারিত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার কথাও জানিয়েছে ব্র্যাক।

জরিপে দেখা যায়, গড়ে ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে উদ্বেগ-আতঙ্কের চিত্র দেখা গেলেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা দেখা গেছে বেশি মাত্রায়। তাদের মধ্যে এ অবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থী।

নারী শিক্ষার্থী, মাধ্যমিক পড়ুয়া, পল্লী অঞ্চলের বাসিন্দা ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে উদ্বেগ-আতঙ্কে ভোগার হার ১৭ শতাংশ।

আতঙ্কে ভুগলে কী করে এ প্রশ্নের উত্তরে তারা জানিয়েছে, একেবারেই নীরব হয়ে যায়, মেজাজ খারাপ করে, পড়াশোনা বা খেলাধুলা কোনোটাই করে না, বাইরের কাউকে দেখলে আতঙ্ক বোধ করে, একা থাকতে ভয় লাগে প্রভৃতি।

করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে পড়ালেখার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হওয়ার কথা জানিয়েছে ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখার ব্যাপারে নির্দেশনা না পাওয়া এর একটি কারণ বলে প্রতীয়মান হয়।

জরিপে বলা হয়, ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশেষ করে মাদ্রাসা ও গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা এই সমস্যার কথা জানিয়েছে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২২ শতাংশ ঘরে খাদ্যাভাবকে এজন্য দায়ী করেছে, যা মাদ্রাসা ও শহরাঞ্চলে বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি।

ব্র্যাক বলছে, ৯০ শতাংশ উত্তরদাতা করোনাকালীন পরিচ্ছন্নতা বিধি (সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা) মেনে চললেও ১০ শতাংশ তা মেনে চলছে না।

দেশের ৩ কোটি ১০ লাখ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় এই উপাত্ত যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলে জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে ১৮ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছে, তারা সাধারণ ছুটি বা লকডাউন চলাকালেও বাড়ি থেকে বাইরে চলাচল করেছে।

জরিপের উপাত্ত অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকালীন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ৩% শিক্ষার্থী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে (৮২%) এসব নিপীড়নের ধরন মানসিক। তবে শারীরিক ও যৌন নিপীড়ন, ঘরে বন্ধ করে রাখা বা জোর করে কাজ করানোর মতো ঘটনাও জানিয়েছে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা।

এখানেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা অন্যদের চেয়ে বেশি, সে সংখ্যা ১৬ শতাংশ। এছাড়া ২ ভাগ নারী শিক্ষার্থী নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথা বলেছে।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, নারী শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা আরও বেশি হতে পারে। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে তথ্য দিতে হয়ত সংকোচ বোধ করেছে।

শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ অর্থাৎ ৫৪ ভাগ স্কুল খোলার পর বাড়তি ক্লাস করে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।

তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে চলেছে, তা জানা থাকলেও ৪৯ শতাংশ এখনই স্বল্প সময়ের মধ্যে স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে।

এছাড়া পাঠ্যসূচি বা সিলেবাস ছোট করা এবং পরীক্ষায় কড়াকড়ি শিথিল করার পক্ষেও অনেকে মত দিয়েছে।

করোনাভাইরাসের সময়ে মানসিক চাপ বা ক্ষতি নিরাময়ের কিছু উপায়ও বলেছে উত্তরদাতা শিক্ষার্থীরা। স্কুল খোলার পর বিনোদনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ, উপহার প্রদান, উপবৃত্তির অর্থ বাড়ানো এবং দূরশিক্ষণ ও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে আরো জোরদারে পদক্ষেপ গ্রহণ রয়েছে এসব পরামর্শের মধ্যে।

দূরশিক্ষণে সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে দ্রুত এই কার্যক্রমকে শক্তিশালী করে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে জরিপ প্রতিবেদনে মত প্রকাশ করা হয়।

ব্র্যাকের উর্ধ্বতন পরিচালক কে এ এম মোর্শেদের সঞ্চালনায় জরিপ প্রকাশের ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন।

মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম ও অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) রতন চন্দ্র পণ্ডিত, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক তপন কুমার ঘোষ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ, এটুআই প্রকল্পের উপদেষ্টা আনীর চৌধুরী, ইউনেস্কোর শিক্ষা বিভাগের প্রধান সুন লি, ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিক্ষা বিভাগের প্রধান নূর শিরিন মো. মোক্তার, যুক্তরাজ্য সরকারের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি)-এর মানব উন্নয়ন বিষয়ক টিম লিডার ফাহমিদা শবনম, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈদেশিক সহায়তা বিভাগ ইউএসএইড-এর আলী মো. শহিদুজ্জামান এবং ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির পরিচালক ড. শাফিকুল ইসলাম অনুষ্ঠানে আলোচনায় যোগ দেন।