মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার আন্দোলনের ‘অগ্রপথিক’ কামাল লোহানীর মৃত্যুতে তার নানা অবদান স্মরণ করেছেন শোকার্ত রাজনীতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
শনিবার সকালে রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৮৬ বছর বয়সী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। মৃত্যুর আগে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
কামাল লোহানীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া ও চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন শোক বার্তায় বলেন, “সর্বজন শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অতন্দ্র অধিনায়ক। প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী এ দিকপালের তিরোধানে জাতি একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারাল।”
কামাল লোহানীর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ বলেন, “দেশের শিল্প ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে এবং সাংবাদিকদের অধিকার আদায় ও দক্ষতা উন্নয়নে তিনি আমৃত্যু একনিষ্ঠ অবদান রেখেছেন। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই কৃতি ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে দেশ ও জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল, যা সহজে পূরণ হবার নয়।”
কামাল লোহানীর জন্য শোক জানিয়েছেন ঢাকার দুই মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও আতিকুল ইসলাম।
শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, “সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে সব সময় সরব থেকে দেশ ও জাতিকে আলোর পথের সন্ধান দিতে আমৃত্যু নিবেদিত ছিলেন। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে তার সরব পদচারণা ও কর্মযজ্ঞ এদেশের প্রতিটি মানুষকে প্রেরণা যোগাবে।”
ভাষা সংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম ‘পুরোধা ব্যক্তিত্ব’ কামাল লোহানীর মৃত্যুতে প্রগতিশীল আন্দোলনের ‘অপূরণীয় ক্ষতি হল’ বলে মন্তব্য করেছেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ আলম।
কামাল লোহানীর সংগ্রামমুখর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মীদের অগ্রসর হতে হবে বলে মন্তব্য করেন সিপিবি নেতারা।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “কামাল লোহানী কেবল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিকই ছিলেন না, তিনি একই সঙ্গে ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তি।
“তিনি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি আয়ুববিরোধী সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদ স্বৈরাচারীবিরোধী সংগ্রামে সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিকতার ময়দান থেকে সামনের সারিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি এদেশের অসাম্প্রাদায়িক গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মানুষ গঠনে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে গেছেন।”
কামাল লোহানীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাম ঐক্য ফ্রন্ট, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী), ঐক্য ন্যাপ।
বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও মহাসচিব আবদুল মান্নানও কামাল লোহানীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন।
তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারের সাংবাদিক হিসেবে তার অবদানের কথা জাতি কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করবে।”
কামাল লোহানীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। এই কমিটির সদস্য ছিলেন কামাল লোহানী।
কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল চৌধুরী বলেন, “ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে তার ভূমিকা জাতি চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।”
বাংলাদেশ সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের শোক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “কামাল লোহানী বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুধু একটি নাম নয়, তিনি এক ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের আন্দোলন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন- সর্বক্ষেত্রে সর্বাগ্রে থাকা মানুষ তিনি।
“তার মৃত্যু জাতির অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গন তার মৃত্যুতে এক গুণী অভিভাবক হারাল।”
কামাল লোহানী ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বিবৃতিতে দিয়েছে নির্মূল কমিটিও।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রবল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, স্বৈরাচার, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সব নাগরিক আন্দোলনের একজন পুরোগামী নেতা ছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সূচিত -৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার আন্দোলনে তিনি ছিলেন অকুতোভয় এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ।”
নির্মূল কমিটির তরুণ নেতা কর্মীদের জন্য তিনি ‘আদর্শবাদ ও আপসহীনতার এক উজ্জ্বল বাতিঘর’ হিসেবে সব সময় অফুরন্ত প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন বলেও মন্তব্য করেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতারা।
২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দুই দফায় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন কামাল লোহানী।
এক শোকবার্তায় উদীচীর সভাপতি অধ্যাপক সফিউদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন বলেন, “কামাল লোহানীর মৃত্যুতে দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনে এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হল। দেশ হারাল এক সূর্য সন্তানকে। দেশের প্রগতিশীল আন্দোলন তার শারীরিক অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুধাবন করবে।
“শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও কামাল লোহানীর চেতনা-আদর্শ দেশের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পাথেয় হয়ে থাকবে। উদীচী তার আদর্শকে ধারণ করেই কামাল লোহানীর অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে বদ্ধপরিকর।”
এক শোকবার্তায় উদীচীর সভাপতি অধ্যাপক সফিউদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন বলেন, “কামাল লোহানীর মৃত্যুতে দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনে এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হল। দেশ হারাল এক সূর্য সন্তানকে। দেশের প্রগতিশীল আন্দোলন তার শারীরিক অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুধাবন করবে।
“শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও কামাল লোহানীর চেতনা-আদর্শ দেশের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পাথেয় হয়ে থাকবে। উদীচী তার আদর্শকে ধারণ করেই কামাল লোহানীর অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে বদ্ধপরিকর।”
উদীচী কার্যালয়ে শেষ শ্রদ্ধা
শনিবার সকালে মৃত্যুর পর কামাল লোহানীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর শেখেরটেকে। সেখানে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী মরদেহ গোসলের পর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নিয়ে আসা হয় তোপখানা রোডে উদীচী কার্যালয়ে।
এ সময় উদীচীর সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ারসহ কেন্দ্রীয় নেতারা এবং কামাল লোহানীর পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সেখানে উদীচী ছাড়াও শ্রদ্ধা জানায় জাতীয় শ্রমিক জোট, ওয়ার্কাস পার্টি, বিবর্তন সাংস্কৃতিক ফোরাম, কেন্দ্রীয় খেলাঘর, হাতেখড়ি, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন, নবনাট্য সংঘ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, সিপিবি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীসহ বিভিন্ন সংগঠন।
শ্রদ্ধা নিবেদনের শেষ পর্যায়ে উদীচীর শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করেন ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে', 'ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা', ‘কে বলেছে হয় না' এবং ‘ও আলোর পথযাত্রী’ গানগুলি।
পরে কামাল লোহানীর মরদেহবাহী গাড়িটি জাতীয় পতাকা এবং উদীচীর পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর তার মরদেহ দাফনের জন্য নেওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের সুনতলা গ্রামে।