রেড জোন: বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন হবে যেভাবে

করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার বিবেচনায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে লাল, হলুদ ও সবুজ- এই রঙের ‘জোনে’ ভাগ করার পর কীভাবে বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করা হবে সে বিষয়ে একটি রূপরেখা দিয়েছে সরকার।

জয়ন্ত সাহাশহীদুল ইসলাম ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 June 2020, 05:25 PM
Updated : 15 June 2020, 05:25 PM

লাল অঞ্চলে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ মঙ্গলবার যে আদেশ জারি করেছে সেখানে ‘জোনিং’ কার্যকরের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৈরি করা গাইডলাইনে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।

সংক্রমণের ঝুঁকি যেখানে বেশি, সেই এলাকাই হবে রেড জোন। জেলা, উপজেলা, এলাকা, মহল্লা বা বাড়ি ধরে রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউনের মত বিধিনিষেধে জারি করা হবে।

লাল অঞ্চলে জীবনযাত্রা ‘কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ’ করা যাবে। অফিস-কারখানা সব থাকবে বন্ধ। যানবাহন ও সাধারণের চলাচলে থাকবে কড়াকড়ি। বাজার বা মার্কেটও থাকবে বন্ধ। এসব বিধিনিষেধ চলবে অন্তত তিন সপ্তাহ।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কোন অঞ্চলের সতর্কতার মাত্রা কেমন হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী তারাই লাল, হলুদ বা সবুজ জোন ঘোষণা করবে।

আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সরকারের অনুমোদন নিয়ে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন অনুযায়ী কোনো এলাকাকে লাল, হলুদ বা সবুজ জোন হিসেবে ঘোষণা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জেলার সিভিল সার্জনকে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সিভিল প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা ও সশস্ত্র বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তা নিয়ে তিনি জোনিং কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবেন।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গত শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, ‘দুয়েক দিনের মধ্যেই’ সারা দেশে অধিক সংক্রমণ এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা শুরু হবে।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সোমবার বলেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেখানে যখন প্রয়োজন, তখন ‘রেড জোন’ ঘোষণা করা হবে। সেজন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন তারিখ ঠিক করা হয়নি।

“কাজেই রেড জোন ঘোষণা বা রেড জোন পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই যখন প্রয়োজন তা করা হবে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়ন করবে। এই বিষয়ে সকলের বিভ্রান্তি নিরসন হওয়া প্রয়োজন।”

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাহ আলী ফরহাদ এক ফেইসবুক পোস্টে লকডাউন ঘোষণার সময় নিয়ে বিভ্রান্তি নিরসনের চেষ্টা করেছেন।

 

করোনাভাইরাসের বিস্তার দুই মাসের বেশি সময় সারাদেশে লকডাউন জারি রাখার পর ৩১ মে থেকে বেশিরভাগ বিধিনিষেধ তুলে নেয় সরকার।

তবে এরপর প্রতিদিন সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে এলাকা ধরে ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অনুযায়ী লাল, সবুজ ও হলুদ জোনে ভাগ করে প্রয়োজন অনুযায়ী বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত হয়।

সে অনুযায়ী গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং নরসিংদী জেলার কিছু এলাকা এবং ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারে ‘পরীক্ষামূলক জোনিং সিস্টেম’ চালু করা হয়েছে। ঢাকার ওয়ারীতেও একই ধরনের ব্যবস্থা নিতে এলাকা চিহ্নিত করার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন জেলা ও সিটি করপোরেশনও গাইডলাইন অনুসারে স্থানীয় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে। সে অনুযায়ী তারা প্রয়োজনীয় সুপারিশ তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতামত অনুযায়ী ‘জোনিং সিস্টেম’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে।

এলাকাভিত্তিক লকডাউনের পরিকল্পনায় ঢাকার প্রথম এলাকা হিসেবে পূর্ব রাজাবাজারের গলিপথ বাঁশ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

জোন ঠিক হবে কীভাবে

উচ্চ ঝুঁকির এলাকায় লাল: ঢাকা মহানগরীর যেসব এলাকায় আগের ১৪ দিনে প্রতি লাখ নমুনা পরীক্ষায় ৬০ জন বা তার বেশি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হবে, সেসব এলাকা হবে ‘রেড জোন’।

আর ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষেত্রে রেড জোন ঘোষণা করা হবে যদি আগের ১৪ দিনে প্রতি লাখে ১০জন বা তার বেশি রোগী শনাক্ত হয়।

মাঝারি ঝুঁকির এলাকায় হলুদ: ঢাকা মহানগরীর ক্ষেত্রে কোথাও প্রতি লাখ নমুনা পরীক্ষায় ৩ থেকে ৪৯ জন বা তার বেশি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হলে ওই এলাকাকে এবং ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রতি লাখে ৩ থেকে ৯ জন রোগী শনাক্ত হলে ওই এলাকাকে ‘ইয়েলো জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।

কম ঝুঁকির এলাকায় সবুজ: যেসব এলাকায় জোনিং এর শুরু থেকে কোনো কোভিড-১৯ রোগী পাওয়া যায়নি, অথবা আগের ১৪ দিনে প্রতি লাখে তিন জনের কম রোগী শনাক্ত হয়েছে, সে এলাকাকে ‘গ্রিন জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।

কোনো এলাকাকে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করার পর পরিস্থিতি উন্নতি হলে তিন সপ্তাহ লাল লঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য বিধিনিষেধ বলবৎ থাকবে। কোনো এলাকার রঙ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সর্বশেষ ১৪ দিনের সংক্রমণ পরিস্থিতির তথ্য পর্যালোচনা করে।

 

কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করা হয়েছে ঢাকার পূর্ব রাজাবাজার এলাকা। কেউ প্রবেশ ও বের হতে পারবেন না, তাই অনেককেই দেখা যায় ভেতরে থাকা স্বজনদের জন্য বাইরে থেকে বাজার কিনে দিতে।

লাল লঞ্চলের বিধিনিষেধ

কোনো এলাকাকে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করা হলে সেখানে যেসব বিধিনিষেধ প্রযোজ্য হবে, তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

>> গ্রামঞ্চলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কৃষিকাজ করা যাবে। কলকারখানা ও কৃষিপণ্য উৎপাদন কারখানাও খোলা রাখা যাবে।

>> রেড জোন শহরাঞ্চলে হলে সব বন্ধ থাকবে। বাসা থেকেই অফিসের কাজ করতে হবে।

>> কোনো ধরনের জনসমাবেশ করা যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুধুমাত্র জরুরি প্রয়োজনে বাসা থেকে বের হওয়া যাবে।

>> রেড জোনে রিক্সা ভ্যান, অটোরিকশা, ট্যাক্সি বা নিজস্ব গাড়ি চলাচল করবে না। জোনের ভেতরে সড়ক নৌ বা রেলপথেও কোনো বাহন চলতে পারবে না। তবে মালবাহী নৌযান বা জাহাজ রাতে চলাচল করতে পারবে।

>> সীমিত আকারে প্রবেশ ও বের হওয়ার পয়েন্ট নির্ধারণ করে কঠোরভাবে জনগণের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা হবে। অসুস্থ ব্যক্তি পরিবহনকারী গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে চলাচল করবে।

>> রেড জোনে মুদি দোকান ও ওষুধের দোকান খোলা রাখা যাবে। রেস্তোরাাঁ ও খাবারের দোকান কেবল হোম ডেলিভারি দিতে পারবে। শপিংমল, সিনেমা হল, জিম/ স্পোর্টস কমপ্লেক্স, বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ থাকবে।

>> স্বাস্থ্যবিধি মেনে এটিএম-এর মাধ্যমে টাকা তোলা যাবে। কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং সেবা চালু রাখা যেতে পারে।

>> রেড জোনে পর্যাপ্ত কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। শনাক্ত রোগীরা হোম আইসোলেশন বা প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে থাকবেন।

>> মসজিদে কেবল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সামাজিক দূরত্ব রেখে প্রার্থনা করতে পারবেন। বাকিরা করবেন যার যার বাসায়।

>> বাইরে গেলে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে হবে। হাত ধোয়া, জীবাণুমুক্ত করা এবং দূরত্ব রেখে চলাফেরার নিয়ম মানতে হবে।

>> স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, হাসপাতাল ও জরুরি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। তবে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- স্কুল, কলেজ, কোচিং সেন্টার পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।

এলাকাভিত্তিক লকডাউনের পরিকল্পনায় ঢাকার প্রথম এলাকা হিসেবে পূর্ব রাজাবাজারের গলির প্রবেশ পথ মঙ্গলবার মধ্যরাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, এসব বিধিনিষেধের পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সোমবার জারি করা নির্দেশগুলোও অনুসরণ করতে হবে।

সেখানে বলা হয়েছে, লাল অঞ্চলে অবস্থিত সামরিক বা অ-সামরিক সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বয়ত্তশাসিত বা বেসরকারি দপ্তরগুলো এবং লাল অঞ্চলে বসবাসকারী সব দপ্তরের কর্মকর্তারা সাধারণ ছুটির আওতায় থাকবে।

হলুদ ও সবুজ অঞ্চলের সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি অফিস নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সীমিত পরিসরে খোলা রাখা যাবে। বিধিনিষেধের সময় কেউ কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবে না।

প্রত্যেকটি জোনের জন্য কোভিড নমুনা পরীক্ষা, কোভিড-ননকোভিড স্বাস্থ্যসেবা প্রোটোকল, কোয়ারেন্টিন/আইসোলেশন, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, জন চলাচল, যান চলাচল, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, খাবার ও ওষুধ সরবরাহ, দরিদ্র লোকদের জন্য মানবিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

মসজিদ-মন্দির অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্মচর্চা, জনসচেতনতা তৈরি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ব্যাংকিং সুবিধাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান/শিল্প প্রতিষ্ঠান/ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিষয়ে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর’ তৈরি করতে হবে।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জেলা বা উপজেলা প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো সমন্বিতভাবে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। এ কার্যক্রমে সংসদ সদস্যরাসহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ স্বেচ্ছাসেবীসহ অন্যদের সম্পৃক্ত করতে হবে।