পাপুলের কুয়েতি সহযোগীদের পেছনে গোয়েন্দারা

অর্থপাচার ও মানবপাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার বাংলাদেশি সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে ‘অপরাধ কর্মকাণ্ডে’ তার বেশ কয়েকজন কুয়েতি সহযোগীর সন্ধান পেয়েছে দেশটির গোয়েন্দারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 June 2020, 08:39 PM
Updated : 14 June 2020, 08:39 PM

তদন্তে এখন পর্যন্ত কুয়েতের সাতজন সাবেক-বর্তমান সরকারি কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করার কথা পাবলিক প্রসিকিউশনের বরাতে জানিয়েছে দেশটির সংবাদ মাধ্যম।

রোববার কুয়েতের ইংরেজি সংবাদপত্র আরব টাইমস জানিয়েছে, টানা আট দিনের রিমান্ড শেষে পাপুলকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক রাখার নির্দেশ দিয়েছে প্রসিকিউশন বিভাগ।

তার সঙ্গে আটক থাকতে হচ্ছে মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপের আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মুর্তজা মামুনকে, যাকে পাপুলের বিরুদ্ধে তদন্ত চলার মধ্যে আটক করা হয়।

আরব টাইমস লিখেছে, পাপুলের অপরাধের সহযোগী হিসাবে এই পর্যন্ত সাতজন ‘বিশিষ্ট সরকারি’ কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করেছে সরকারি কৌঁসুলিরা। তাদের মধ্যে চারজন অবসরপ্রাপ্ত এবং বাকিরা তিনটি সরকারি সংস্থার প্রধান।

এই কর্মকর্তারা ঘুষ ও উপঢৌকন নিয়ে পাপুলের কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

আরব টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাপুল কর্তৃক ইউরোপীয় ও উপসাগরীয় অঞ্চলের ব্যাংকগুলোতে মিলিয়ন মিলিয়ন দিনারের সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে বলে জেনেছেন তদন্তকারীরা। মানবপাচার, অর্থপাচার ও ভিসা বাণিজ্যের অভিযোগ আসার পর কুয়েত থেকে ব্যবসায় গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন তিনি।

পাপুল নিজের অপরাধের সঙ্গী হিসাবে কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তাকেও ঘুষের বিনিময়ে কাজে লাগিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

শহিদ ইসলাম পাপুল

গত ৬ জুন রাতে কুয়েতের মুশরিফ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পাপুলকে। দেশটির পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট এই ব্যবসায়ী মারাফি কুয়েতিয়া কোম্পানির মালিকদের একজন।

তাকে গ্রেপ্তারের পর কুয়েতি গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছিল, পাঁচ বাংলাদেশির স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পাপুলের বিরুদ্ধে মানবপাচার, অর্থপাচার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন।

ওই ব্যক্তিরা প্রসিকিউশনকে জানিয়েছিল, তিন হাজার কুয়েতি দিনার খরচ করে পাপুলের মাধ্যমে সেদেশে গিয়েছে তারা। শুধু তাই নয়, ভিসা নবায়নের জন্য ফি বছর টাকা দিতে হয় তাদেরকে।

আটকের পরদিন থেকে পাপুলকে জামিন না দিয়ে রিমান্ডে দেয় কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউশন বিভাগ। এরই মধ্যে অভিযোগ সম্পর্কে ১১ জন ব্যক্তির সাক্ষ্য নিয়েছেন নিয়েছেন তদন্তকারীরা।

তদন্ত চলার মধ্যে পাপুলের কুয়েতের বাসায় অভিযান চালিয়ে চেক জব্দ করার পাশাপাশি অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়ার খবর দিয়েছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। পাপুলের প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মামুনের পাশাপাশি একজন মিশরীয় অভিবাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পাপুলকে গ্রেপ্তারের পর তদন্ত চলার মধ্যে এটিকে ‘সবচেয়ে বড়’ মানবপাচারের ঘটনা হিসাবে বর্ণনা করেছেন কুয়েতের উপ-প্রধানমন্ত্রী আনাস আল-সালেহ।

পাপুলের ‘অর্থপাচার ও মানবপাচারের’ সঙ্গে কুয়েত সরকারের কারও বিরুদ্ধেও যদি জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা আল-সালেহ এক টুইটে বলেছেন, ”বিগত কয়েক সপ্তাহে অভিবাদন পাওয়ার মতো কাজ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মীরা। যেটা একজন এশীয় অভিবাসীর মাধ্যমে সবচেয়ে বড় মানব পাচারের ঘটনা প্রকাশ করেছে।

”তদন্তে সন্দেহভাজন আর্থিক লেনদেনের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কর্মকর্তা ও কোম্পানিগুলোর একটি নেটওয়ার্ক এ কাজে সহযোগিতা করেছে।”

কুয়েতের রাজনীতিতেও পাপুলের গ্রেপ্তারের বিষয়টি বড় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে দেশটির বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম।

পাপুলের অর্থপাচার ও মানবপাচারের সঙ্গে মন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তাদের নাম প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন আবদুল করিম আল-কানদারিসহ বেশ কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য।

কুয়েতি পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যও পাপুলের অর্থপাচার ও মানবপাচারের ঘটনায় ফেঁসে যেতে পারেন বলে আভাস দেওয়া হয় কুয়েতি গণমাধ্যমে। বিষয়টি নিয়ে দেশটির দুর্নীতি দমন কমিশন যেন তদন্ত করে সেই দাবিও উঠেছে।

সাধারণ শ্রমিক হিসাবে কুয়েত গিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়া পাপুল ২০১৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শুধু তাই নয়, নিজের স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করে আনেন তিনি।

প্রবাসী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান পাপুল, যেখানে তার বিপুল অঙ্কের শেয়ার রয়েছে।

পাপুলের মালিকানাধীন মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি কাজ করেন বলে কুয়েতে বাংলাদেশ কমিউনিটির ধারণা।

কোম্পানির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, সেবা খাত, নিরাপত্তা, নির্মাণ, আবাসন, পরিবহন, তেল শোধন প্রভৃতি খাতে কার্যক্রম রয়েছে মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপের। কুয়েতের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ব্যবসায় রয়েছে তাদের।

তাকে আটকের পরদিন বিষয়টি নিয়ে কুয়েত সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চেয়েছিল সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস; এখনো সেটির উত্তর আসেনি বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত এসএম আবুল কালাম।