ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশন নিয়ে বিভক্তি

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেই এবার আগেভাগেই বার্ষিক সিনেট অধিবেশন ডাকায় প্রশ্নের মুখে পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 June 2020, 03:21 PM
Updated : 13 June 2020, 03:58 PM

বিভিন্ন অভিযোগ ও কারণ দেখিয়ে রোববারের এই অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ সিনেটের বেশ কয়েকজন সদস্য।

তাদের অভিযোগ, পছন্দের কয়েকজন সিনেট সদস্যকে সিন্ডিকেটে মনোনয়ন দিতেই তড়িঘড়ি করে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অধিকাংশ সদস্যের উপস্থিতি নিশ্চিত না হয়েই উপাচার্য একক সিদ্ধান্তে এ অধিবেশন ডেকেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সিনেট সদস্য জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত সিনেট অধিবেশনে ভোটের ফল জালিয়াতি করে বিতর্কিত উপাচার্যের প্যানেল নির্বাচনের কার্যবিবরণী অনুমোদন এবং করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কমিটি গঠনসহ কিছু বিষয়ে উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে কেউ যাতে সিনেটে প্রশ্ন তুলতে বা আলোচনা করতে না পারেন, সেজন্য উপাচার্যের অনুগত স্বল্পসংখ্যক সদস্যের উপস্থিতিতে সিনেট অধিবেশন সম্পন্ন করতে এই চেষ্টা।

এছাড়া সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস পরীক্ষার ল্যাব বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়েও প্রশ্ন ওঠতে পারে বলে জানান তারা।

সাধারণত প্রতি বছর জুনের শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের বার্ষিক অধিবেশন ডাকা হয়। এ অধিবেশনের অন্যতম আলোচ্যসূচি থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেট উত্থাপন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয় সিনেট অধিবেশনে।

শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩ এর ২১ ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে উপাচার্য সিনেটের এই বার্ষিক অধিবেশন আহ্বান করছেন।
বিজ্ঞপ্ততিতে বলা হয়েছে, “করোনা পরিস্থিতির জন্য সিনেটের এই বাষির্ক অধিবেশন স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য অনুষ্ঠিত হবে।”

করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শুধু সিনেট সদস্য এবং সীমিত গণমাধ্যমকর্মী ছাড়া অন্য কাউকে অধিবেশনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।

এই অধিবেশনে বাজেট উত্থাপন না হলেও ৬-৭টি আলোচ্য বিষয় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

তারা জানান, অধিবেশনে সিনেট থেকে মনোনীত সিন্ডিকেটের সাত, আট ও নয় সদস্যের মনোনয়নের এজেন্ডা রয়েছে। আগামী ১৬ জুন সিনেটের ৩৫ জন শিক্ষক প্রতিনিধির মেয়াদ শেষ হবে। তাই তাদের মেয়াদ থাকতেই পূর্ণাঙ্গ সিনেট সভার জন্য এ অধিবেশন ডাকা হয়েছে।

অধিবেশনে অংশ না করার বিষয়ে এরই মধ্যে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরীন আহমাদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ অধিবেশনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট উত্থাপন নিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সাধারণত এটা জুনের শেষের দিকে হয়। কিন্তু বাজেট প্রণয়ন না করেই তড়িঘড়ি করে আগামীকাল (রোববার) অধিবেশন ডাকা হয়েছে। মূলত উপাচার্য তার নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কোভিড-১৯ এর ঝুঁকির মধ্যেই এ অধিবেশন ডেকেছেন।”

অধিবেশনে যোগ না দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি এ অধিবেশনে যাচ্ছি না। ট্রেজারারও চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনিও যাবেন না। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটই প্রণয়ন হয়নি, সেখানে এ ধরনের অধিবেশনের প্রশ্নই ওঠে না। এই অধিবেশনের মূল কারণ হতে পারে ৩৫ জন শিক্ষকের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া এবং উপাচার্যের পছন্দের সিন্ডিকেট মনোনয়ন দেওয়া।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডন্যান্স অনুযায়ী কোষাধ্যক্ষ বাজেট প্রণয়ন করেন। পরে তা ফাইন্যান্স কমিটি ও সিন্ডিকেটে পাস করানোর পর সিনেটে উত্থাপন করা হয়। সিনেট অধিবেশনকে কেন্দ্র করে বাজেট প্রণয়ন করতে চাপ ছিল কোষাধ্যক্ষের ওপর। পরে গত ৭ জুন উপাচার্যকে পাঠানো এক দীর্ঘ চিঠিতে এ সময়ের মধ্যে বাজেট প্রণয়ন সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন কোষাধ্যক্ষ। প্রয়োজনে তিনি ছুটিতে গিয়ে অন্যজনকে দিয়ে বাজেট প্রণয়নের প্রস্তাব দেন।

চিঠিতে কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল উদ্দীন বলেন, “সামগ্রিক পরিস্থিতিতে আর্থিক বিধি-বিধান মেনে ন্যূনতম নির্ভুল একটি বাজেট তৈরি করা এই সময়ে সম্ভব নয়। এখনও ফাইন্যান্স কমিটিতে তা উপস্থাপন হয়নি। সুতরাং সিন্ডিকেটে উপস্থাপনের সুযোগ নেই। বাজেটের বিষয়টি জরুরি মনে করলে, আমি সাময়িক ছুটি নিতে পারি, উপাচার্য মহোদয় প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেন।”

এমন পরিস্থিতিতে চিঠি দিয়ে রোববারের সিনেট অধিবেশনে অংশ না নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ফাইন্যান্স কমিটির প্রধান উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) মুহাম্মদ সামাদও।

তিনি বলেন, “জাতীয় বাজেট অধিবেশন সরকারের জন্য বাধ্যবাধকতা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের জন্য কোনো অধিবেশনের বাধ্যবাধকতা নেই । সাধারণত ২৭- ২৯ জুনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সিনেট অধিবেশন হয়ে থাকে।

“এখন যে অধিবেশন ডাকা হয়েছে, এটা বিধিসম্মত হয়নি। তাছাড়া সিনেটে ১০৫ জন সদস্য রয়েছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল মেডিকেল কলেজসহ সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অনেক সদস্যেরই অধিবেশনে যোগ দেওয়া অনিশ্চিত।”

তবে বিধি মেনেই সিনেটের অধিবেশন ডাকা হয়েছে বলে দাবি করেছেন উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সব ধরনের বিধি মেনেই এ অধিবেশন ডাকা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে কেউ আসতে না চাইলে এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। দীর্ঘদিন পর এখন আমাদের পূর্ণাঙ্গ সদস্য নিয়ে সিনেট আছে। আগামী ১৬ জুন সিনেটের ৩৫ জন শিক্ষক প্রতিনিধির মেয়াদ শেষ হবে।

“এছাড়া ২২ জুন ডাকসুর মনোনীত পাঁচজন সিনেট সদস্যেরও মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এরপর সভা হলে আমরা তাদের সম্মান জানাতে পারব না, ধন্যবাদ দিতেও পারব না। তাই সহকর্মীদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানাতেই অধিবেশন এগিয়ে আনা হয়েছে।” 

সিনেট সদস্যদের একাংশের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “একটি পক্ষ বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানহানি করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। সিনেটে বাজেট উত্থাপন করতে হবে তেমন কোনো বিধি নেই। মূলত এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স কমিটি ও সিন্ডিকেটে অনুমোদিত হয়। সিনেটে শুধু উপস্থাপন করা হয়।”

উপাচার্য বলেন, “বাজেটের জন্য এ অধিবেশন ডাকা হয়নি। এই অধিবেশনে আমাদের ৬-৭টি এজেন্ডা রয়েছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে আমরা ‘বঙ্গবন্ধু রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ চালু করব। গত বুধবার সিন্ডিকেটের সভায় তা অনুমোদিত হয়েছে। আগামীকাল সিনেটে তা উত্থাপন করা হবে।”