প্রতিবছর বাজেট পেশের দিনটিতে সংসদ ভবন জুড়ে থাকে উৎসবের আমেজ; কিন্তু বৃহস্পতিবার ছিল ভিন্ন চিত্র। চিরচেনা উৎসবের আমেজের বদলে সর্বত্র ছিলো কঠোর সতর্কতা।
প্রবেশ পথ থেকে অধিবেশন কক্ষ- সব যায়গায় ছিল স্বাস্থ্য সুরক্ষার কড়াকড়ি। মূল ভবনে দায়িত্ব পালন করেছেন স্বল্প সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী।
বাজেট উপস্খাপনের দিন সংসদ অধিবেশন কক্ষ সাধারণত পূর্ণ থাকলেও দূরত্ব রেখে বসার পরিকল্পনা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার উপস্থিত ছিলেন ৭৮ জন আইনপ্রণেতা।
সংক্ষিপ্ততম সময়ে বাজেট পেশ করার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে এবার জাতীয় সংসদে। অতীতে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টার মত বাজেট বক্তব্য দেওয়াও রেকর্ড থাকলেও সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে এবার বাজেট উপস্থাপন করা হয় সংক্ষিপ্ত পরিসরে।
সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন না বিরোধী দলীয় রওশন এরশাদ। আগে থেকেই জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্যদের অধিবেশনে আসার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল, কারণ যাদের স্বাস্থ্য জটিলতা আছে এবং যাদের বয়স বেশি, তারাই ঝুঁকিতে আছেন সবচেয়ে বেশি।
অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামালের বাজেট বক্তব্য ছিল ৪৭ মিনিটের। তবে এর মধ্যে তিনি নিজে পাঠ করেছেন সব মিলিয়ে ৬ থেকে ৭ মিনিটের মত। বাকিটা উপস্থাপন করা হয়েছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে, ভিডিও উপস্থানার মধ্য দিয়ে।
বিগত অর্থবছরে বাজেট পেশের পাশাপাশি তার চুম্বক অংশ পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনায় দেখানো হলেও এবারই প্রথম অর্থমন্ত্রী পাঠ না করে প্রায় পুরো অংশই ডিজিটাল পদ্ধতিতে উপস্থাপন করলেন।
এবার সংসদ ভবনের প্রবেশমুখে সকলকেই ‘জীবাণুমুক্ত করণ’ চেম্বারের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। মেপে দেখা হয়েছে তাপমাত্রা।
অধিবেশন কক্ষে এক থেকে দুটি আসন পরপর বসেছিলেন সাংসদরা। অধিকাংশের মুখে ছিল মাস্ক, হাতে গ্লাভস ও মাথায় প্রতিরোধক টুপি। সংসদ পরিচালনায় দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এক ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
প্রতিবছর বাজেট উত্থাপনের দিন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সংসদে উপস্থিত থাকলেও এবার কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। পুরো বাজেট অধিবেশনে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারও স্থগিত করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বরাবরের মতই সংসদে উপস্থিত থেকে বাজেটের উপস্থাপনা দেখেন। তবে তার সংসদ ভবনে প্রবেশের সময় ছিল না কোনো আনুষ্ঠানিকতা। অন্যবছর বিউগল বাজিয়ে তাকে স্বাগত জানানো হয়। লোক সমাগম কমাতে এবার তা বাদ দেওয়া হয়।
অন্যসময় মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের সময় অনেকে উপস্থিত থাকেন। এবার নথিপত্র সই করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন কেবল অর্থ সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান। ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া এবং প্রধান হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।
আগামী ২৯ জুন অর্থ বিল পাস হবে। আর বাজেট পাস হবে ৩০ জুন। এর আগে আগামী রোববার থেকে বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হবে।
সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে, একই সতর্কতা মেনেই বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা চলবে। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত আলোচনা হবে। সংসদ সদস্যরা কে, কবে অংশ নেবেন তা ইতোমধ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবছর সংসদ ভবনের সাত তলায় গণসংযোগ শাখা থেকে গণমাধ্যম কর্মীদের বাজেটের নথিপত্র বিতরণ করা হয়। কিন্তু এবার তা মূল ভবনের বাইরে মিডিয়া সেন্টার থেকে দেওয়া হয়েছে।
সংসদের খবর সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা সংবাদকর্মীদের সংগঠন বাংলাদেশ পার্লামেন্ট জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজেএ) সভাপতি উত্তম চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ৩০ বছর ধরে আমি সংসদের খবর সংগ্রহ করি। কিন্তু এবারই এমন দেখলাম যে বাজেট উপস্থাপনার দিন সংসদ ভবনে কোনো সংবাদকর্মী নেই।
“কিছু করারও নেই আমাদের। মহামারী থেকে বাঁচতে হলে এমন পরিস্থিতি মেনে নিতেই হবে।”
সংবিধানের নিয়ম রক্ষায় গত ১৮ এপ্রিল ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম অধিবেশনে বসে জাতীয় সংসদ। তখনও আইনপ্রণেতাদের বসানো হয় দূরত্ব বজায় রেখে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমাদের বিশ্বাস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনায় রচিত এ বাজেটের হাত ধরেই ইনশাহ আল্লাহ আমরা শিগগির পূর্বের উন্নয়নের ধারায় ফিরে যাব। যে অমানিশার অন্ধকার আজ আমাদের চারপাশকে ঘিরে ধরেছে মহান আল্লাহর কৃপায় সেটি কেটে যাবে। আমরা মহান আল্লাহর রহমতে ফিরে পাব স্বাভাবিক জীবন; ফিরে পাব একটি আলোকিত সকাল।”
বাজেট বক্তৃতায় কোরআনের আয়াতও পাঠ করেন অর্থমন্ত্রী।
বাজেট উপস্থাপনের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, “হে আমাদের প্রভু, তুমি যদি রক্ষা না রো আমাদের রক্ষা করবে কে? তাই সবার পক্ষ থেকে প্রার্থনা- তুমি কখনও আমাদের বঞ্চিত করবে না রহমত থেকে।… সবার জীবন মহান আল্লাহর কৃপায় আলোয় উদ্ভাসিত হোক।”
“একে অপরের সাহায্যে করোনাভাইরাস মোকাবিলা যুদ্ধেও আমরা জয়ী হবো, ইনশাআল্লাহ। এই ক্রান্তিকালে বিভ্রান্ত, ভীত বা আতঙ্কিত না হয়ে আমাদের ধৈর্য্য এবং সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে”।