জীবন-জীবিকার চ্যালেঞ্জ সামলাতে কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ?

পেছনে অর্থনীতির বিপুল ক্ষতি, আর সামনে গভীর অনিশ্চয়তা; মানুষের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি জীবিকা নিশ্চিতের কঠিন সমীকরণ মেলাতে গিয়ে আরও অনেক দেশের মত লকডাউন শিথিলের পথে হেঁটেছে সরকার, যাকে একজন মন্ত্রী বর্ণনা করেছেন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে।

মঈনুল হক চৌধুরীরিয়াজুল বাশার ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 June 2020, 07:13 AM
Updated : 8 June 2020, 07:21 AM

কিন্তু এমন এক সময়ে মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে ‘স্বাভাবিক’ কর্মকাণ্ডে ফেরার চেষ্টা করতে হচ্ছে, যখন দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী।  

প্রশ্ন আসছে- লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত কতটা সময়োপযোগী ছিল? সংক্রমণ পরিস্থিতি যেখানে এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি, সেখানে আংশিক কর্মশক্তিকে কাজে ফিরিয়ে অর্থনীতি আসলে কতটা সচল করা সম্ভব? মন্দের এই সময়ে সেই ভালোর পেছনে ছোটার জন্য যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, বাংলাদেশ তার কতটা নিতে পেরেছে?

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বলেছেন, বিধিনিষেধ তখনই শিথিল করার প্রশ্ন আসে যখন সংক্রমণ কমতে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ইউরোপে বিধিনিষেধ শিথিল হয়েছে সংক্রমণের হার কমার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সংক্রমণ বাড়তে থাকার মধ্যে যদি কেউ তা (শিথিল) করে থাকে, সেটাতো জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।”

সেই ঝুঁকি নিয়েই লকডাউন তোলার পর গত এক সপ্তাহ অর্থনীতির চাকা খুব একটা সচল করা গেছে বলে মনে করছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সরকারি অফিসে ২৫ শতাংশ উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে। গণপরিবহন আর ট্রেন চলাচল পুরোদমে শুরু হয়নি। বড় বড় শপিং মলও খোলেনি।

“তার মানে, সীমিত পরিসরে খুলে দিলেও সব কিছু এখনও স্বাভাবিক হয়নি। বলতে পারি- মুভমেন্ট বেড়েছে; অর্থনীতিতেও কিছুটা গতি বেড়েছে। তাতে এখন অর্থনৈতিক ক্ষতি আগের রেটে হচ্ছে না। তবে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার সময় এখনও হয়নি।”

দুই মাসের লকডাউন শেষে বিধিনিষেধ শিথিল করার সময় সামনের দিনগুলোর জন্য স্পষ্ট কোনো কৌশল যে সরকারের ছিল না, এক সপ্তাহ পর সংক্রমিত এলাকাগুলোকে তিনটি জোনে চিহ্নিত করে স্থানীয়ভাবে অবরুদ্ধ রেখে মহামারী নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগেই তা স্পষ্ট হয়। 

মার্চে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর ২৫ মার্চ থেকে সরকার ‘ছুটি’ ঘোষণা করে চলাচল ও্ সামাজিক মেলামেশায় বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। তবে তার পুরোপুরি বাস্তবায়ন দেখা যায়নি বহু জায়গায়।

ফলে এখন অর্থনীতি সচল করার পথে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়ার ওপরই জোর দিচ্ছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কেএএস মুর্শিদ।

তার যুক্তি, স্বাস্থ্যখাতের জনবল যদি সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে যেতে পারে, তাহলে অন্য খাতেও সেটা সম্ভব।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “প্রস্তুতি নিয়ে আপনি খুলে দেন। কিন্তু প্রস্তুতি নিতে হবে এবং সিরিয়াসলি নিতে হবে। যতটা সম্ভব ততটা নিতে হবে। শতভাগ না পারেন অন্তত ৯০ শতাংশ নিতে হবে। আমাদের সাপও মারতে হবে, লাঠিও ভাঙ্গা যাবে না।”

কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে ঢাকার সদরঘাটে লঞ্চ ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি করে নামতে দেখা যায় যাত্রীদের, যেখানে সামাজিক দূরত্ব নিয়ে কোনো সচেতনতাই ছিল না। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

যে অবস্থায় লকডাউন শিথিল হয়েছে

বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী ধরা পড়েছিল গত ৮ মার্চ। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০০ ছাড়াতে লেগেছিল প্রায় এক মাস। ওই অবস্থায় ২৬ মার্চ থেকে সব অফিস আদালত ও যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয় সরকারের তরফ থেকে। 

এই লকডাউনের মধ্যেই এপ্রিলে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ৪ মে রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যেই দোকান-পাট, কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত আসে। ৩১ মে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সবকিছুই খুলে দিয়ে ‘সীমিত আকারে’ কর্মকাণ্ড শুরুর কথা বলা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, লকডাউনের শেষ দিন ৩০ মে শনাক্ত রোগী সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ৬০৮ জন। সে পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছিল ৬০১ জনের।

রোববার শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৬৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮৮৮ জন। তার মানে এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ২১ হাজার রোগী বেড়েছে দেশে। 

সন্ধ্যার পরে দোকানপাট খোলা না রাখা, রাতে চলাচল সীমিত করাসহ বিভিন্ন বিধিনিষেধ সরকারের তরফ থেকে এখনো জারি রাখা হয়েছে।   

কিন্তু যানবাহনে গাদাগাদি ভিড়, বাজার-দোকানে দূরত্ব বজায় না রাখা, পার্কে মানুষের জটলা করে বসে থাকার চিত্র আসছে নিয়মিত।

ফলে অফিস-কারখানায় সংক্রমণ ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে নতুন করে ‘কঠোর লকডাউন’ জারির দাবি আসছে বিভিন্ন মহল থেকে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলছেন, করোনাভাইরাস সঙ্কট আর দুই মাসের লকডাউনে দেশের অর্থনীতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে বিধিনিষেধ শিথিল করে কাজে ফেরার কোনো বিকল্প ছিল না।

“আমরা মন্দের ভালো হিসেবে লকডাউন তুলে নিয়েছি। পশ্চিমা বিশ্বের কাছে আমরা রপ্তানি করে খাই। যেসব উন্নত দেশে আমরা পণ্য রপ্তানি করি সেসব দেশও ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। এখন তারা একটি শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে গিয়ে তাদের অর্থনীতি আবারও সচল করে দিয়েছে। তারা এখন টুকটাক অর্ডারও দেওয়া শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের অর্থনীতি খোলা না থাকলে চরমভাবে পিছিয়ে পড়ব।”

এখন স্থানীয়ভাবে লকডাউন করে মহামারী নিয়ন্ত্রণের যে কৌশল সরকার নিয়েছে তা বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

এ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “সংক্রমণ ও মৃত্যু- দুটোই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এখন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবই ওপেন হয়ে গেছে। বিস্তার ঠেকাতে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ‘ম্যাচিং ও জোনিং’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নই এখন অন্যতম অবলম্বন।”

পুরো দেশের সিটি, জেলা, উপজেলা ও ওয়ার্ডভিত্তিক হালনাগাদ তথ্য পেলেই স্থানীয় সরকার বিভাগ জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নামবে বলে জানান তিনি।

বিআইডিএস মহাপরিচালক কেএএস মুর্শিদ মনে করেন, এ অবস্থায় ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এররের’ মধ্যে দিয়েই এগোতে হবে।

“আমাকে তো কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে, নিচ্ছেও অনেকে। যেমন দেখেন যারা স্বাস্থ্যখাতে আছেন তারা কি কাজ করছেন না? তারা ঝুঁকিও যেমন নিচ্ছেন, সুরক্ষার জন্যও অনেক ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এভাবেই সবাইকে চলতে হবে।”

প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্তের পর এর বিস্তার ঠেকাতে পুরান ঢাকার নারিন্দার মনির হোসেন লেন লকডাউন করা হয়েছে।

মাঠের চিত্র

ঢাকা মহানগর আর জেলা মিলিয়ে এ পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা পুরো দেশে মোট শনাক্ত রোগীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ। 

এছাড়া চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ- দুই জেলাতেই শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। গাজীপুর আর কুমিল্লাতেও হাজার ছাড়িয়েছে।

শুরুর দিকে সবেচেয়ে বেশি সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছিল ঢাকা ও পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জ থেকে। নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী মার্চেই লকডাউন বা কারফিউ ঘোষণার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি জানিয়েছিলেন।

এরপর সরকার পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলাকে অবরুদ্ধ ঘোষণা করলেও তার বাস্তবায়ন পুরোপুরি হয়নি। নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে বহু মানুষ দেশের অন্যান্য জেলায় গেছেন ওই লকডাউনের মধ্যেও, সঙ্গে নিয়ে গেছেন ভাইরাস।

সরকারের সাধারণ ছুটির মধ্যে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হলে বিভিন্ন জেলা থেকে দলে দলে শ্রমিকরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে আসেন কর্মস্থলে যোগ দিতে। সমালোচনার মুখে কারখানায় ছুটি বাড়ানো হলে তাদের অনেকে আবার ফিরেও যান।

ফেরি, ট্রাক, পিকআপ, নসিমন বোঝাই করে পোশাক শ্রমিকদের কারখানায় ফেরার সেই ছবি দেখে অনেকেই তখন সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছিলেন।

ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকার মধ্যেই ঈদের সময় আরেকবার ঘরমুখো মানুষের ভিড় দেখা যায়। কয়েকদিন বাদে শুরু হয় ঢাকামুখী মানুষের ঢল। এরপর সাধারণ ছুটি আর না বাড়িয়ে ১৫ জুন পযন্ত ‘সীমিত আকারে’ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালুর ঘোষণা আসে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশের ৪২টি প্রতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে মোট ছয় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে ২৫ শতাংশ জনবল দিয়ে ১৫ই জুন পযন্ত অফিস চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কিন্তু প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মক্ষেত্র তৈরি পোশাক খাতে এখন কত শ্রমিক কাজে ফিরেছেন সে তথ্য জানাতে পারেনি পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

বিধিনিষেধ শিথিল করার পর দেশে বেসরকারিখাতে কত মানুষ কাজে যোগ দিয়েছেন- এই প্রশ্নের উত্তরও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সংশ্লিষ্টদের কাছে পায়নি।

করোনাভাইরাসের বিস্তারের মধ্যে স্বাস্থ্য বিধি মেনে সচল ঢাকার মিরপুরের একটি পোশাক কারখানা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

অর্থনীতির ক্ষতি কতটা

প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় থাকায় উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বাংলাদেশ করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো অংক এখনও পাওয়া যায়নি। 

তবে পরকিল্পনামন্ত্রী মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসে যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে দেশ।

“আমি গবেষক নই বলে ক্ষতির পরিমাণ বলতে পারব না। তবে আমার ধারণা, এক বছরের অর্থনীতির চারভাগের এক ভাগ ক্ষতি হয়ে গেছে।”

গত অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেয়েছিল বাংলাদেশ, চলতি বছর তা ৮ দশমিক ২ শতাংশে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল।

কিন্তু আইএমএফ মনে করছে, করোনাভাইরাসের ধাক্কায় চলতি বছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৩.৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে। আর বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, প্রবৃদ্ধি হবে ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বিডিনিউজ টোযেন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মে পর্যন্ত দুই মাসে কৃষি, শিল্প ও সেবাখাতে ২ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতির প্রাক্কলন করা হয়েছিল। ঈদ ও বৈশাখী বাজারের বড় ক্ষতিও এর মধ্যে যুক্ত হবে।

“এখন ক্ষতি কত তা গবেষণার বিষয়। আমরা সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ ধরেছিলাম। এখন এক সপ্তাহে অর্থনীতির চাকা খুব যে সচল হয়েছে তা বলা যাবে না। আর্থিক ক্ষতি হয়ত কিছু কমবে; কিন্তু খুব বেশি যে কমেনি তা বলাই যায়।”

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে এক সিট খালি রেখে বাসে যাতায়াত করতে বলা হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্য ও স্টাফদের পরিবহনের এই বাসে তা দেখা যায়নি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এখন কী করবে বাংলাদেশ?

সরকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত আকারে চালু রেখে ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এলাকাগুলোকে সংক্রমণের মাত্রাভেদে লাল, সবুজ ও হলুদ জোনে ভাগ করে বিধিনিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে। তাতে পরিস্থিতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? 

মুশতাক হোসেন বলেন, “সারা দেশেতো সংক্রমণের একইরকম অবস্থা থাকে না, যেখানে ক্লাস্টার আছে এবং সে ক্লাস্টারে যদি গণসংক্রমণ হয়, তাহলে সেখানে চলাচলের সীমাবদ্ধতা রাখতে হবে সর্বোচ্চ। যেরকম হয়েছিল মিরপুরের টোলারবাগ আর মাদারীপুরের শিবচরে।”

তিনি বলেন, এলাকা বড় হলে বেষ্টনী তৈরি করতে হবে, গণহারে সংক্রমণ হলে বেষ্টনী হবে নিবিড়ভাবে। আর সারাদেশেই যেহেতু সংক্রমণ হচ্ছে, সেহেতু চলাচলে যেন ভিড় না থাকে তাও নিশ্চিত করতে হবে।

“একজনের সঙ্গে অন্যজনের যেন শারীরিক দূরত্ব বজায় থাকে, কোথাও কোনো সমাবেশ যেন না হতে পারে, বাজার ঘাটে একে অপরের সংস্পর্শ যেন এড়ানো যায়- এটা সব এলাকার জন্যই প্রযোজ্য।”

স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে স্থানীয়ভাবে অবরুদ্ধ করে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কী না- এ প্রশ্নে মুশতাক হোসেন বলেন, “কিন্তু কোথায় ঘটছে সেটা বের করা কষ্টকর না। কটা রোগী কোন জায়গায় আছে সে তথ্য স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে আছে। তবে সামাজিক নিপীড়ণের ভয়ে অনেক সময় সঠিক ঠিকানা দেয় না।

“এটা একটা জনস্বাস্থ্য সমস্যা। জনগণের সহযোগিতা নিয়েই সেটা কার্যকর করতে হবে। পুলিশ, কারফিউ- এসব একেবারেই সেকেলে। হ্যাঁ, পুলিশ অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে, কিন্তু কমিউনিটিকে সঙ্গে নিয়ে।”

সেজন্য মহামারী নিয়ন্ত্রণে কী করা দরকার, সেই তথ্য মানুষকে জানানোর এবং সচেতনতা বাড়াতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দেন এই বিশেষজ্ঞ।

অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলছেন, আবার যদি লকডাউনের মত বিধিনিষেধ দেওয়া হয়, তাহলে সেটা যেন পুরোপুরি কার্যকর হয়। আর তার আগে যেন প্রস্তুতিটাও ঠিকঠাক নেওয়া হয়।

এ গবেষকের পরামর্শ, যে এলাকা অবরুদ্ধ করা হবে, সেখানকার গরিব মানুষের জন্য ১৫ থেকে ২১ দিনের খাবার, পানীয় এবং ওষুধ পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে।

“আগের মতো লকডাউন করে লাভ নেই, কার্যকর লকডাউন করতে হবে। পাশাপাশি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার পরিসর বাড়ানো দরকার।”

অবশ্য আগের লকডাউনে সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্য নাগরিকদের ‘সচেতনতার অভাবকে’ দায়ী করছেন জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।

তিনি বলেন, “সরকার প্রথম থেকেই সংক্রমণের বিস্তার রোধে বেশ তৎপর ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, শিল্পকারখানা, গণপরিবহন-সবখানে ছুটি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা ছুটির সদ্ব্যবহারটা করতে পারিনি। জনগণ সামাজিক দূরত্বের নিয়ম অনুসরণ করলে আজকের এমন অবস্থা হয়ত হত না।”

জবরদস্তি করে এর বাস্তবায়ন সম্ভব না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সাপোর্ট না পাওয়ার কারণে এখন সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে চলছে। সামনে তাই স্বাস্থ্য সেবা ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ।”

বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. মুর্শিদ বলেন, প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে কিছু সুযোগও থাকে। আর তা কাজে লাগাতে যে পারবে, সেই টিকে থাকবে।

“এই অবস্থা কতদিন চলবে তা আমরা জানি না। আমরা যদি ধরে বসে থাকি যে পৃথিবী ২০১৯ সালে যেমন ছিল আবার তেমন হয়ে যাবে… এটা নাও তো হতে পারে। হলেও কত বছর লাগবে জানি না। সুতরাং এই নতুন বাস্তবতা মাথায় রেখেই এগোতে হবে।”

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন জাফর আহমেদ ও ফয়সাল আতিক]