হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক: ধর্মীয় বিতর্কের পর করোনাভাইরাস

জন্মের পর শিশুর জন্য অত্যাবশ্যকীয় মাতৃদুগ্ধ না পাওয়া গেলে তাদের সেই চাহিদা পূরণে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল গত বছরের শেষ দিকে।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2020, 04:27 AM
Updated : 7 June 2020, 04:27 AM

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এই উদ্যোগের খবর শুনে তাতে আপত্তি করেছিলেন ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। অন্যান্য ইসলামী দেশেও এ ধরনের উদ্যোগের কথা জানিয়ে তাদের কিছুটা শান্ত করা গেলেও গুরুত্বপূর্ণ এই উদ্যোগ এখন আটকে আছে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে।  

এর মধ্যে জন্মের পরই মা হারানো বিপন্ন শিশুর জন্য অন্য মায়ের বুকের দুধ চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আহ্বান জানানো হয়েছে। তাতে সাড়াও মিলেছে। তবে তার বাইরে থেকে যাওয়া আরও বহু শিশুর জন্য কিছু করতে না পারার দুঃখবোধ রয়েছে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তাদের মধ্যে।

ঢাকার মাতুয়াইলের সরকারি শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে (আইসিএমএইচ) এ মিল্ক ব্যাংক স্থাপনের জন্য বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল আধুনিক যন্ত্রপাতি।

দামী ওই সব যন্ত্রপাতি দীর্ঘ দিন ধরে পড়ে আছে বলে জানিয়েছেন হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের উদ্যোক্তা মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ডা. মুজিবুর রহমান।

তিনি শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মিল্ক ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে ‘আলেম সমাজের একাংশ’ শুরুতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। এজন্য মিল্ক ব্যাংক সংক্রান্ত সব কাগজপত্র তারা ইসলামিক ফাউন্ডেশনে পাঠিয়েছেন।

“বিষয়টি সুরাহা করতে আলেম সমাজের প্রতিনিধি ছাড়াও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের একটি বৈঠকে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিছু শর্তে তারা মিল্ক ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দিতে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু বৈঠকটাই তো আর হচ্ছে না।”

সম্প্রতি রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন শিক্ষিকা মারা যান। তার সাতদিন বয়সী শিশুকে দুগ্ধ দান করতে আহ্বান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়।

এ বিষয়টি উল্লেখ করে ডা. মুজিবুর রহমান বলেন, “মিল্ক ব্যাংক থাকলে হয়ত ওই বাচ্চার জন্য দুধ জোগাড় করে দেওয়া সহজ হত। এটা তো প্রমাণিত যে বিষয়টা কত জরুরি। তার বাচ্চাটাকে মায়ের দুধ দেওয়ার জন্য সবাই চেষ্টা করছে। এ ব্যবস্থাটি চালু থাকলে ওই বাচ্চার মতো আরও অনেক বাচ্চার কষ্ট দূর হত।”

তিনি জানান, মিল্ক ব্যাংকের জন্য সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তির অনুদানে যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। দীর্ঘদিন সেগুলো অব্যবহৃত পড়ে আছে।

“প্রায় ১০-১২ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। আলেম সাহেবরা হয়ত মনে করেছেন বিদেশি কোনো দাতা সংস্থা দিয়েছেন। কিন্তু এসব যন্ত্রপাতি কিনতে যারা আর্থিক সহায়তা করেছেন তারা সবাই মুসলিম। নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে আমি মাঝে মাঝে মেশিনগুলো চালু করি।”

ডা. মুজিবুর বলেন, মিল্ক ব্যাংক হলে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যেন কোনো সমস্যা তৈরি না হয় সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবেন তারা।

“আমরা কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করছি। একজন মায়ের দুধ শুধু একটা বাচ্চাকেই খাওয়ানো হবে। এ বিষয়ে তাদের দুজনেরই বিস্তারিত তথ্য আমরা লিখে রাখব। ছেলে বাচ্চার মায়ের দুধ ছেলেকে, মেয়ে বাচ্চার মায়ের দুধ মেয়ে বাচ্চাকে খাওয়ানো হবে।”

ভিকারুননিসার ওই শিক্ষিকার পরিবারের একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিশুটির জন্য দুগ্ধদান করতে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

মাতৃদুগ্ধ না পাওয়া আরেকটি শিশুর একজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। পেশায় চিকিৎসক ওই নারী বলেন, দেশে একটা হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক হওয়া খুবই জরুরি।

মাতুয়াইলের সরকারি শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, যেখানে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক চালুর প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়

“অনেক বাচ্চা মায়ের দুধ না পেয়ে কষ্ট করছে। অনেক বাচ্চার মা মারা যায়, আবার অনেক মা বাচ্চাকে প্রয়োজনীয় দুধ দিতে পারে না। তারা উপকার পেত। বাংলাদেশে এ বিষয়ে তো কোনো উদ্যোগ নাই। উল্টো নানা ধরনের ফর্মুলা ফিডিং কীভাবে বাজারজাত করবে সেদিকে বেশি ব্যস্ত।”

বিষয়টির অগ্রগতি জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (এমএনসি অ্যান্ড এএইচ) ডা. মো. শামসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ বিষয়ে ইতিবাচক।

“এজন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়েছি। সরকারের অনুমোদনের জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে যুক্ত করা হচ্ছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিটিং ডেকেছিল। বায়তুল মোকাররমে মিটিং করার তারিখও ঠিক হয়েছিল। তবে করোনাভাইরাসের কারণে দেরি হচ্ছে।”

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব কাজী নুরুল ইসলাম জানান, এ বিষয়ে তারাও ইতিবাচক। ভুল বোঝাবুঝির অবসানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতিদের পাশাপাশি বাইরের কয়েকজন মুফতিকেও বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। সবার মতামত নিয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে একটা সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।

“পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, মালয়েশিয়াসহ বেশ কিছু মুসলিম দেশে যেহেতু এটা চালু আছে সে কারণে আমাদের দেশেও করা যায় কি না তা দেখতে হবে।”

নুরুল ইসলাম বলেন, “ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটা জায়েজ হবে কি না। এর গ্রহণযোগ্যতা কতটা এগুলো নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ করার প্রস্তুতি আমরা নিয়েছিলাম। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এটা পিছিয়ে গেছে। তবে আমরা আশাবাদী যে এটা করা যাবে।”

মিল্ক ব্যাংকের গুরুত্বের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। মায়ের দুধ খাওয়া শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি ২১ শতাংশ কমে যায়। এটা গবেষণায় প্রমাণিত।

“অনেক কারণে শিশু তার মায়ের দুধ পায় না। সেক্ষেত্রে মিল্ক ব্যাংক কাজে আসতে পারে। অনেক সময় মা মারা যায়। আবার মা জীবিত আছে, কিন্তু বাচ্চা অপরিণত। এনসিইউতে রাখার কারণে সে মায়ের দুধ খেতে পারছে না। ওই মা তার দুধ ব্যাংকে জমা রাখবে, বাচ্চা সুস্থ হয়ে দুধ খেতে পারবে।

“আবার কারও মা মারা যাওয়া শিশুকে অন্য মায়ের রেখে দেওয়া দুধ দেওয়া যাচ্ছে। এই কাজগুলো মিল্ক ব্যাংক থাকলে সহজেই করা যায়।”

তবে পুরো বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে ও নিখুঁত উপায়ে করার উপরে গুরুত্ব আরোপ করেন এই শিশু বিশেষজ্ঞ।

মিল্ক ব্যাংক স্থাপনের পরিকল্পনা শুনেই হালাল-হারামের বিষয় জড়িয়ে আছে দাবি করে এই উদ্যোগের বিরোধিতায় নামেন ওলামাদের একটি অংশ। এতে আইনগত ও ধর্মীয় সমস্যা তৈরি হবে দাবি করে উকিল নোটিশও পাঠানো হয়।

মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণে ‘মিল্ক ব্যাংক’ স্থাপনের বিরুদ্ধে যথাযথ শর্ত আরোপ চেয়ে ২৪ ডিসেম্বর ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইসিএমএইচ), নবজাতক পরিচর্যা কেন্দ্র (স্কানো), নবজাতক আইসিইউ (এনআইসিইউ) এবং ঢাকা জেলা প্রশাসককে আইনি নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহমুদুল হাসান।