হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরে গাড়িতেই মৃত্যু

বাথরুমে পড়ে আঘাত পেয়েছিলেন মো. এনায়েত উল্ল্যাহ (৭২); অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে অক্সিজেন দিতে হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরেছেন স্বজনরা; কিন্তু ভর্তি করাতে পারেননি।

কামাল তালুকদার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 June 2020, 01:28 PM
Updated : 6 June 2020, 02:22 PM

শেষে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তির আগেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই বৃদ্ধ।

করোনাভাইরাস মহামারীকালে অসুস্থ শ্বশুরকে নিয়ে একের এর এক হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি করাতে না পারার দুর্বিষহ ঘটনা জানিয়ে আবদুল কাইয়ুম বলেন, “এভাবে মাথায় আঘাতের রোগীকে যদি করোনা রোগী ভেবে ভোগান্তিতে পড়তে হয়, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়?”

গত ৩০ মে রাতে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকার বাসার বাথরুমে পড়ে যান এনায়েত। স্থানীয় চিকিৎসক দেখিয়ে মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে বাসায়ই চিকিৎসা চলছিল তার।

কিন্তু শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দুদিন বাদে কাছের রূপগঞ্জের কর্নগোপ এলাকার ইউএস বাংলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে, দেওয়া হয় অক্সিজেন।

ওই হাসপাতালের অক্সিজেন সঙ্কট দেখা দেওয়ায় নতুন হাসপাতাল খুঁজতে হয় এনায়েতের পরিবারকে। অসুস্থ এনায়েতকে একটি গাড়িতে নিয়ে বের হন তার স্ত্রী, ছেলে, পুত্রবধূ, মেয়ে ও জামাতা।

গত বৃহস্পতিবার সেই খোঁজা শুরু করার পরই দুঃসহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান কাইয়ুম।

তিনি বলেন, ইউএস বাংলা হাসপাতাল থেকে তারা সানারপাড়ের একটি হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তারা, কারণ ওখানে আইসিইউ ছিল।

বৃহস্পতিবার সকালে ওই হাসপাতালে নেওয়ার পর তাদের ভোগান্তি শুরু হয়।

কাইয়ুম বলেন, “প্রাইভেটকারে রোগী রেখেই একজন নার্স এসে তাপমাত্র মেপে দেখেন ১০০ ডিগ্রি (ফারেনহাইট)। উনারা রোগীকে নিচে না নামিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলেন।”

দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল টিকেট কাটার পর রোগীকে কোভিড-১৯ ইউনিটে নিতে বলা হয় বলে জানান কাইয়ুম।

“আমরা বারবার বলছিলাম, উনার করোনাভাইরাস নেই। পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছেন।

ডাক্তার আমাদের কোনো কথাই শোনেনি।”

পরে এক স্বজনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এনায়েতকে। এই হাসপাতালেও আইসিইউ রয়েছে।

কাইয়ুম বলেন, “ভর্তির সব কাজ প্রায় শেষ, কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিকেটে কোভিড-১৯ সাসপেক্টেড দেখে উনারা ভর্তি নিলেন না।”

তখন এনায়েতকে নিয়ে তার স্বজনরা মুগদা হাসপাতালে নিয়ে যান।

কাইয়ুম বলেন, “কিন্তু উনারও ভর্তি নিতে গড়িমসি করে। পরে অনেক অনুরোধে রাজি হলেও টিকেটের নিচে লিখে দেয় যে, ‘আমার রোগী কোভিড-১৯ প্রতিবেদন না থাকা সত্ত্বেও এই হাসপাতালে ভর্তি করাতে ইচ্ছুক। এমতাবস্থায় পরবর্তীতে কোভিড-১৯ প্রতিবেদন নেগেটিভ হলে অথবা মৃত্যুবরণ করলে সরকারি নিয়ম অনুসারে লাশ আঞ্জুমান মফিদুলে হস্তান্তর করতে রাজি আছি’।”

কাইয়ুম বলেন, “তখন আমার স্ত্রী, শ্যালক ও শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিই যে, যেহেতু মারা গেলে করোনা রোগী ধরে দাফন করবে, মৃতদেহ দেবে না, তাহলে এখানে রোগীকে ভর্তি করাব না।”

তখন হাসপাতাল থেকে এনায়েতকে পুনরায় গাড়িতে বসানো মাত্রই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।

ওই প্রাইভেটকারটির চালক জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাই, সারাটা দিন ঘুরলাম আর দেখলাম, ভালো রোগীকেও ধরে না। আমার সামনে অ্যাম্বুলেন্সেই একজনকে মরতে দেখলাম।”

দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটার পর থেকে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করাতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। সরকারের পক্ষ থেকে নানা হুঁশিয়ারির পরও ভোগান্তির অবসান ঘটছে না।

বেশির ভাগ রোগীর স্বজনদের অভিযোগ এই ধরনেরই।

 এই রোগীর স্বজনদের অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং মুগদা হাসপাতালের বক্তব্যের জন্য চেষ্টা করেও তা পাওয়া যায়নি।

কাইয়ুম জানান, তার শ্বশুরকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারের সামাজিক কবরস্থানে দাফন করেছেন তারা।