কোভিড-১৯ ‘নেগেটিভ’ হয়েও ছিলেন ইউনাইটেডে আইসোলেশনে, মারা গেলেন অগ্নিকাণ্ডে

ভারনন এ্যান্থনী পলের করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফল ‘নেগেটিভ’ এসেছিল, তারপরও তাকে আইসোলেশন ইউনিটে রেখেছিল ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, আর সেখানেই অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু ঘটে এই স্ট্রোকের এই রোগীর।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 June 2020, 06:06 PM
Updated : 4 June 2020, 07:20 PM

ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে ভারনন পলের জামাতা রোনাল্ড মিকি গমেজ যে মামলা করেছেন, সেই মামলায় তিনি অভিযোগ করেছেন, করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফল আসার পর অনুরোধ করেও তার শ্বশুরকে মূল ভবনে স্থানান্তর করতে পারেননি তারা।

গত ২৭ মে রাতে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে যে পাঁচ রোগীর মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে ভারনন পলসহ দুজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন না বলে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালেও কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার নির্দেশনা সরকার দেওয়ার পর ইউনাইটেড হাসপাতাল তাদের ভবনের সামনের প্রাঙ্গণে ছোঁয়াচে এই রোগ আক্রান্তদের জন্য আইসোলেশন ইউনিট তৈরি করে।

কোভিড-১৯ রোগ ছোঁয়াচে বলে এতে আক্রান্ত রোগীদের আলাদা রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়, যাকে আইসোলেশন বলে।

মিকি গমেজ বলেছেন, ব্রেইন স্ট্রোকের পর গত ২৫ মে দুপুরে তার ৭৪ বছর বয়সী শ্বশুরকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। তখন কোভিড-১৯ ‘নেগেটিভ’ প্রতিবেদনও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছিল।

এজাহারে বলা হয়, কিন্তু তারপরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মিকি গোমেজ এবং তার সঙ্গে থাকা শ্যালক অ্যান্ড্রে ডোমিনিক পলকে জানিয়ে দেয়, করোনাভাইরাসের রোগীদের জন্য তৈরি আইসোলেশন ইউনিটে রেখে তার চিকিৎসা করা হবে।

ভারনন পলকে তখন আইসোলেশন ইউনিটে নিয়ে রাখা হয়। পরদিন ২৬ মে পুনরায় করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য তার নমুনা নেওয়া হয়।

পরদিন বিকাল পর্যন্ত পরীক্ষার ফল না পেয়ে ইউনাইটেডের পরীক্ষাগারে যোগাযোগ করেন মিকি গমেজ, তখন তাকে জানানো হয় যে প্রতিবেদন আইসোলেশন ইউনিটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এজাহারে মিকি গমেজ বলেছেন, “পরে আইসোলেশন ওয়ার্ডে এসে রিপোর্টের বিষয়ে দায়িত্বরত ডাক্তারকে বলার পর তিনিও নেগেটিভ দেখেন, তবে বলেন সংশ্লিষ্ট ডাক্তার আসার পর মূল ভবনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে।

“কিন্তু প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা (রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত) অপেক্ষা এবং অনুরোধ করার পরেও আমার শ্বশুরকে মূল ভবনে স্থান্তান্তর করাতে পারিনি।”

তারপর কিছুক্ষণ পরই আগুন লাগে ওই আইসোলেশন ইউনিটে, যাতে ভারনন পলসহ পাঁচ রোগী।

ভারনন পলকে আইসোলেশন ইউনিটে রাখার বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের চিফ অব কমিউনিকেশন সাগুফা আনোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্লিনিক্যালি যদি নেগেটিভ আসে, তারপরও শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া বা করোনার লক্ষণ, ঝূঁকির মাত্রা যদি থাকে, তাহলে আইসোলেশনে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা মত দেন।”

মামলায় মিকি গমেজ ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যু সংঘটনের অভিযোগ এনেছেন।

তিনি নাম উল্লেখ না করে ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যান, এমডি, সিইও, পরিচালক, অগ্নিকাণ্ডের সময় আইসোলেশন ইউনিটে কর্মরত চিকিৎসক-নার্স, নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের আসামি করেছেন।

আগুন লাগার পর অগ্নিনির্বাপন সরঞ্জাম না পাওয়ার কথা এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

মিকি গমেজ বলেন, ২৭ মে রাত ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে আইসোলেশন ইউনিটের চিকিৎসক ও নার্সদের কক্ষের এসি থেকে সামান্য ধোঁয়া বের হতে দেখেন তিনি। এ সময় বাইরের কক্ষের মূল দরজা খোলা ছিল।

“এসময় চিৎকার করে ওয়ার্ডবয়কে ফায়ার এস্টিংগুইশার আনার জন্য বলা হলে ওয়ার্ডে ইস্টিংগুইশার নেই জানিয়ে তারা ফ্লোর মোছার দাহ্যপদার্থ ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। কিন্ত এতে এসির বডিতে আগুন লেগে বেড়ে যায় এবং গলতে শুরু করে। এসির গলে যাওয়া অংশ নিচে থাকা একটি খালি বিছানার চাদরে পড়ে আগুন লেগে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চাকাযুক্ত বিছানা থাকার পরেও রোগীদের সরানোর কোনো উদ্যোগ না নিযে বা রোগীদের দরজা না খুলে সেখানে থাকা ডাক্তার, নার্সসহ সবাই বের হয়ে যায়। এরপরেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।”

মিকি গমেজ বলেন, আগুন নেভানোর জন্য তিনি নিজে নিরাপত্তার রক্ষীদের কক্ষে গিয়ে সেখানেও ফায়ার এস্টিংগুইশার পাননি। পরে ৯৯৯ ফোন করে ফায়ার ব্রিগেডকে জানান। পরে ফায়ার ব্রিগেড এসে ১০টা ৫মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে দেখা যায়, তার শ্বশুরসহ ৫ রোগীর দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন।

আগুনে পুড়ে যাওয়া গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনাভাইরাস ইউনিট। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এই আগুন কী কারণে লেগেছিল, তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।

ঘটনার পরেই উপ পরিচালক দেবাশীষ বর্ধনের নেতৃত্বে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।

কমিটির প্রধান দেবাশীষ বর্ধন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তারা কাজ গুছিয়ে এনেছেন। এরই মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যদের নিয়ে তারা শনিবার বৈঠকে বসবেন। সেদিনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে রোববার প্রতিবেদন জমা দেবেন।

আগুন কী কারণে লেগেছিল- এর প্রশ্নের জবাবে দেবাশীষ বর্ধন জানান, “এখনও চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে অবহেলার বিষয়টি আপনারা (সাংবাদিক) দেখেছেন, আর বিষয়টি সবাই জানেন। উচ্চ আদালত একটি মতামতও দিয়েছেন।”

মিকি গমেজ এজাহারে বলেছেন, ঘটনার পরদিন বিকালে লাশ আনতে গেলে হিসাব শাখায় যোগাযোগ করতে বলা হয় তাকে। সেখানে যাওয়ার পর দেড় লাখ টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিল দেখে তার শ্বশুরের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রতিবেদন চাওয়া হলে ‘বিল পরিশোধ করলেই কেবল রিপোর্ট দেওয়া হবে’ বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।

ভর্তির সময় ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন মিকি গমেজ; বাকি টাকার বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও আর যোগাযোগও করেনি, পরীক্ষার প্রতিবেদনও দেয়নি বলে জানান তিনি।

এই মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই মামলাটি নিবিড়ভাবে তদন্ত চলছে। আমরা গুরুত্ব দিয়েই তদন্ত করছি।”

এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে পুলিশ। গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার আব্দুল আহাদকে প্রধান করে তিন সদস্যের গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।

“তারা অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবেন,” বলেন সুদীপ চক্রবর্তী।

মামলাটি গ্রহণ করে ইতোমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ৫ জুলাই দিন ঠিক করেছে ঢাকার আদালত।